প্রবন্ধ ১...
কানন জঙ্গল হয়ে গেছে
যা লিখছি, অনেক অসংগতি থাকতে পারে তাতে। ওরাও বলে, আমার মাথাভর্তি অসংগতি। ওরা মানে, শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির লোকজন। অথচ ছোটবেলায় এ-রকম ছিলাম না আমি। শুরুটা একদম অন্য ভাবে হয়েছিল, জানেন! জন্মের পর সকলের কোলে-কোলে। আমাকে নাকি একটা পরি বাগানে ফেলে রেখে গেছিল, মামণি আর বাপি দেখতে পেয়ে টুক করে তুলে নেয়। হাসলে আমার গালে যে মিষ্টি টোল পড়ে, সেটারও গল্প আছে একটা। জানালা দিয়ে ফুড়ুত করে সরু মতো পরি ঘরে ঢুকে আমার গাল টিপে টোলটা বানিয়ে রেখে গিয়েছিল। সব্বাই বলত, আমি নিজেই একটা পরি। বাগানের ঝরনায় স্নান করতে নেমেছিলাম তো, তখন ডানা হারিয়ে যায়! সেই থেকে এখানেই রয়ে গেলাম। পরির মতো সুন্দর সুন্দর ড্রেস কিনে দেওয়া হত আমাকে। পুতুল। ফেয়ারি টেল্স।
মাঝেমধ্যে একটু-আধটু অন্যরকমও হত।
আমার পিসি সে দিন চোখে-মুখে কালশিটে মেখে, স্যুটকেস হাতে, কেমন একটা ভুতুড়ে চেহারা নিয়ে কলিং বেল টিপল, দুম-দুম করে ঘরে ঢুকে পড়ল, পিসান নেই সঙ্গে, কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলবে কী, মা তো সবার আগে আমাকে নিয়ে পড়ল, ‘যাও, উপরের ঘরে গিয়ে খেলা করো, দেখছ না, পিসি রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল!’ তো সে যাক। বাড়ির মধ্যে ফুলের বাগান। খেলে বেড়াচ্ছিলাম নেচে নেচে, লিলি, হাসনুহানা, করবী, মাধবীলতার ঝাড়... পাশের বাড়ির কাজের ছেলে ওদের গ্যারাজে গাড়ি ধুচ্ছিল, হঠাৎ দেখি, ময়ূরের খাঁচার পাশে যে শিক-লাগানো ছোট জানলাটা দিয়ে ও-বাড়ি দেখা যায়, সেখানে এসে ডাকছে আমাকে। বেঞ্চ পাতা ছিল, আমি জানলার নাগাল পাই না, তাই বেঞ্চে উঠে শিক ধরে ওর কাছাকাছি দাঁড়ালাম। অমনি ওর লুঙ্গিটা আলগা করে আমাকে বলল, ‘হাতটা দে, হাতটা দে’, আরে! এ-সব খুলছে কেন? এটা টয়লেট নাকি? আমি তো অবাক। এর পর কত বার, কত বার যে নিজেকে বাথরুম মনে হয়েছে আমার! ওর কথা কাউকে বলিনি। কিন্তু বাগানে আসতে গা ছমছম করত। ও যদি আমাকে আবার ডাকে! ও কি জানে না যে আমি পরি! অমন বিশ্রী ব্যবহার করল কেন?
তার পর এক দিন, তখন ক্লাস ফোর। আমাদের নীচের ঘরে রতনদা থাকত। বাবার কাজিন, ওদের দেখাদেখি আমিও দাদা বলি। ওপরেরটায় না গিয়ে কেন যে সেদিন অত রাতে নীচের টয়লেটে এলাম, এখন আর মনে নেই। কিন্তু তার পর যেই দরজা খুলে বেরিয়েছি, দেখি রতনদা তখনও জেগে আছে। আমাকে এক টানে ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের পায়জামার দড়িটা এক হাতে টানাটানি করতে করতে আমার জাঙ্গিয়াও নীচের দিকে নামাচ্ছে তখন, আর মুখে বলছে ‘কিছু হবে না, কিছু হবে না...’ অ্যাঁ? সবাই আমার গায়ে টয়লেট করতে চায় নাকি? ভয় পেয়ে, কান্না পেয়ে আমার খুব জোর এসে গেল। ছিটকে সরে গিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। বালিশে মুখ ডুবিয়ে ভাবছি, তার মানে আমি কি খারাপ মেয়ে? ফাদার মরাল সায়েন্স ক্লাসে বলেন, ‘দুষ্টুদের সঙ্গে সকলে দুষ্টুমি করে...’, ঈশ্বর! বারবার শুধু আমার সঙ্গেই এটা হচ্ছে কেন? আমার বন্ধুরা অপু, বাপ্পা, ওদেরও কি এমন পানিশমেন্ট পেতে হয়?
আর এক দিন। তখন টয়লেট সিনড্রোম থেকে বেরিয়ে এসেছি। সে দিন পনেরোই অগস্ট। দুপুরবেলা পড়ার ঘরে বসে খুদে-খুদে জাতীয় পতাকা, সে দিনই স্কুল ইউনিফর্মে লাগিয়েছিলাম যেগুলো, নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। মা-পিসি-বাপি কোথায় একটা গেছে যেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ফিরে দেখি ছোটমামা ঘরে ঢুকছে। আমি সোৎসাহে ওর হাতে একটা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ তুলে দিলাম। ও বলল, ‘আয়, তোকে পরিয়ে দিই।’ তার পর সটান হাত ঢুকিয়ে দিল ফ্রকের মধ্যে। চিমটিকাটা ব্যথায় আমি চেঁচিয়ে উঠতেই ঝটপট হাত সরিয়ে নেয়, বলে, ‘ছোড়দিকে বলে দিলে কিন্তু আরও ব্যথা দেব।’ সে-বছরই বাথরুমের মেঝেয় রক্ত দেখলাম। দেখে, প্রাণ উড়ে গেল। তার পর সামলে নিলাম। কিন্তু দিদিভাই পর দিন এসে, সিরিয়াস মুখে জানাল, ‘আজ থেকে বাপি ছাড়া (এখন জেনেছি, বাবাও নিরাপদ নয়) আর কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করবি না। বেশি কাছে ঘেঁষবি না।’ ‘জামাইবাবু?’ ‘ওকেও না।’ আমার চোখে জল এল। আমি তবে মানুষ নই, সুস্বাদু খাবার! আর, ওয়াইল্ড বিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে চার পাশে। কাছে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে!
তাই-ই পড়ল। এক বার নয়, অনেক, অনেক বার। স্টেশনারি দোকানে জিনিস কিনতে গেলে সকলকে দাঁড় করিয়ে রেখে আগে আমাকে ছেড়ে দেয় দোকানদার। শুধু জিনিস আর পয়সা দেওয়া-নেওয়ার সময় চোরের মতো খপ করে ধরে, সুড়সুড়ি দেয়। কী বিশ্রী ভাবে বুকের দিকে তাকায়! বাসে চাপি যখন, হেল্পার কিংবা কন্ডাক্টর যে-ই থাকুক দরজায়, প্রায় কোলে করে উঠিয়ে দেয় গাড়িতে, আর নামব যখন? দরজায় এই একটুখানি ফাঁক রেখে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেই থাকবে। টাইফয়েড হয়েছিল বলে অনার্স ক্লাস করতে পারিনি। পরের দিন ফিজিক্সের স্যার আমাকে ল্যাবের পাশের ছোট ঘরটাতে আসতে বললেন, নোটস দিয়ে দেবেন। আমি তো খুব খুশি। বন্ধুদের আর সাধাসাধি করতে হবে না। হ্যাঁ, নোটস উনি দিলেন। কিন্তু আমার সারা শরীরে অসুখ বুলিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন, মাঝে মাঝে এমন আসি যদি, পরীক্ষার নম্বর আপনিই বেড়ে যাবে।
বিয়ে হল। ভাবলাম, এ বার বুঝি সত্যি-সত্যি একটা মনোরম বাগানে এসে পড়লাম। দিদা আমার নাম রেখেছিলেন মৃত্তিকা। মাকে বলতেন, মেয়েরা মাটির তাল। যে ভাবে গড়বে-পিটবে, তেমনটাই হবে। আর বীজ ধারণ করবে। তবেই না মৃত্তিকা! আমার শ্বশুরবাড়ি হয়তো গড়েপিটে নেওয়ার জুতসই প্রোডাক্ট হিসেবেই নিয়েছিল আমাকে। কবিতা লিখতাম। থামিয়ে দিতে চাইল। শুধুই ঘরকন্না। পারলাম না। স্বাধীনতা বলতে, দিতে চেয়েছিল গড়িয়াহাটের মোড় অবধি একা-একা ভ্রমণ, পারলাম না। নির্দেশ দিয়েছিল, সকলে চা খেলে, খুব ইচ্ছে করলেও আমাকে কফির বদলে চা খেতে হবে, পারলাম না! রোজ রাতে নিয়ম করে, জোলাপ খাওয়ার মতো স্বামী-সহবাস করতে হবে, পারলাম না! চড়চাপাটি খেলে টুঁ শব্দটি করা চলবে না... তার পর, পিসির মতো আমিও এক দিন ফিরে এলাম এ বাড়িতে। এখনও পর্যন্ত আমার বর ছাড়া আর কেউ ডিরেক্টলি ধর্ষণ করেনি আমাকে।
আমার নামকরণের সার্থকতা নির্ণয় করতে বলে যদি কেউ, বলব, যে যখন যেমন ভাবে পেরেছে, বীজ বপনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে এখানে। এখন জানি, আমি পরি নই। আমি জানি, বাড়ির বাইরে পা রাখলেই, খুব কুৎসিত চেহারার প্রকাণ্ড একটা ভয় গিলে ফেলবে আমাকে। বেরোব না! বেরোব না! আমাদের পরিবারের একটা ‘অনার’ আছে তো! কিন্তু আর কবিতা লিখতে পারি না আমি। লিখতে বসলে একই কবিতার দু-তিন লাইন বার বার লিখি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। হি-হি-হি, খুব মজা হয়!
কাননে এসেছ, দেখ, সব শুঁয়োপোকা হয়ে আছে। জলবিছুটির পাতা হয়ে আছে।
দেখ, রঙ্গ নেই, ব্যাডমিন্টন নেই,
কানন, জঙ্গল হয়ে গেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.