মেলে না পরিষেবা, অবহেলায় দিন
কাটাচ্ছেন যক্ষ্মা হাসপাতালের রোগীরা
মনিরুল শেখ • ধুবুলিয়া |
প্রায় পাঁচ দশকের পুরনো ধুবুলিয়া বিধানচন্দ্র রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে মেলে না ন্যূনতম পরিষেবা। পরিবর্তে ঝোপঝাড়ে ঘেরা ওয়ার্ডের ঘরে শুয়ে রোগীরা রোগমুক্তির জন্য কেবল ইষ্ট দেবতার নাম স্মরণ করে চলেন।
দিন কয়েক আগে এক দুপুরে ওই যক্ষ্মা হাসপাতালে গিয়ে চোখে পড়ল বেহাল দশা। প্রায় সাড়ে ন’শো বিঘে জমির উপর গড়া ওই যক্ষা হাসপাতাল এক সময় রোগীর চাপে গমগম করত। এখন আর সে দিন নেই। বেশিরভাগ ওয়ার্ডই ভাঙাচোরা। ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। বেখদলও হয়ে গিয়েছে হাসপাতালের বেশ কিছু ভবন। এখন অবশ্য বাড়িতে বসেই যক্ষ্মা রোগের ওষুধ ডট্স নিলেও রোগের উপশম ঘটে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কমেছে রোগী সংখ্যা। একটি মাত্র ভবনের একপাশে থাকেন জনা সাতাশেক পুরুষ রোগী। অন্য পাশে থাকেন সাকুল্যে তিন জন মহিলা রোগী। রোগীদের সিংহভাগই মারাত্মকভাবে যক্ষ্মাক্রান্ত। রোগী সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে নেমেছে পরিষেবার মানও। ওয়ার্ডের সামনের দিকটা মানুষ সমান ঘন জঙ্গলে ভরা। রোগীরা জানাচ্ছেন, কালেভদ্রেও জঙ্গল সাফ করার জন্য কোনও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর দেখা মেলে না। নবদ্বীপের বাসিন্দা বছর পঞ্চান্নর দীপক দেবনাথ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন মাস দু’য়েক ধরে। দুপুরে বারান্দার পাশে কলে স্নান করতে করতে উগরে দিলেন ক্ষোভ। দীপকবাবু বলেন, “এত বড় একটা হাসপাতালে কোনও জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। গরমের দিনে লোডশেডিং হলে আমরা হাওয়া খেতে বারান্দার দিকে আসি। কিন্তু জঙ্গল বাড়তে বাড়তে বারান্দার কাছে চলে এসেছে। সাপের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয়।” হাসপাতালের বারান্দাতে আকছার ছাগল-গরুর পাল লক্ষ করা যায়। |
হাসপাতালের বারান্দার পাশেই রয়েছে খোলা ড্রেন। দেখেই মালুম হয় বেশ কয়েকদিন ধরে ওই ড্রেন পরিষ্কার হয়নি। ড্রেনের পাশ দিয়ে যেতে গেলে অবধারিতভাবে নাকে রুমাল গুঁজতে হয়। সেই নোংরার পাশেই তোষকহীন একটি বেডে বসে রয়েছেন শীর্ণ চেহারার বক্সার আলি দফাদার। বাড়ি নদিয়ার পলাশিতে। এই নোংরার মধ্যে ওষুধপত্র নিয়ে বসে আছেন কেন? প্রশ্নটা করতেই বক্সার আলি বললেন, “প্রায় দেড় মাস ধরে এখানে রয়েছি। কিন্তু কোনওদিন ঘরে ঝাঁট পড়ে না। দেওয়াল ও ছাদ ঝুলে ভরা। ওখানে থাকা যায় না। তাই কোনওক্রমে রাতটুকু কাটিয়ে সূর্যের আলো ফুটলেই বাইরে চলে আসি।” শৌচাগারও নিয়ম করে পরিষ্কার হয় না বলে অভিযোগ রোগীদের। হাসপাতালে পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। পুরুষ ওয়ার্ডের সামনের একটি মাত্র নলকূপ অনেক দিন আগেই খারাপ হয়ে গেলেও তা সারানোর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের হেলদোল নেই বলে অভিযোগ।
চিকিৎসা পরিষেবা নিয়েও রোগীদের অভিযোগের অন্ত নেই। নবদ্বীপের দীপকবাবু বলেন, “যক্ষ্মা রোগীরা এমতিতেই হাঁফানিতে ভোগে। একটু বেশি কথা বললে এমনকী হাল্কা পরিশ্রমের কোনও কাজ করলেই হাঁফানি শুরু হয়। তাই হাসপাতালে অক্সিজেন মজুত থাকা জরুরি। কিন্তু এখানে অক্সিজেনের কোনও বন্দোবস্ত নেই।” বেথুয়াডহরির ধ্রুব সরকার মাস খানেক ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, “দিন পনেরো আগে হাতের আঙুল কেটে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, ইঞ্জেকশন দিতে হবে। বাইরে থেকে কিনে আনুন।” হাসপাতালের খাবার দাবার নিয়েও রোগীদের ক্ষোভের সীমা-পরিসীমা নেই। কৃষ্ণনগরের মহেশডাঙা এলাকার বাসিন্দা সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল মাস দেড়েক ধরে হাসপাতালে রয়েছেন। বছর ষাটেকের সিদ্বেশ্বরবাবু বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী ১৫০ গ্রাম চালের ভাত দেওয়া কথা। মাছের টুকরোর সাইজ হতে হবে অন্তত ৩০ গ্রাম। কিন্তু এখানে সামান্য ভাত দেওয়া হয়। মনে হয় মাছ ব্লেডে কাটা হয়েছে।’’ সুগার রোগীদের পনির, দই, ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেওয়া হয় না বলে নালিশ রোগীদের।”
কৃষ্ণনগর-২ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ প্রসেনজিৎ গুহ বলেন, “বছর খানেক ধরে যক্ষা রোগীদের দুরবস্থা লক্ষ করছি। এ নিয়ে একাধিকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হাসপাতালের সুপার নির্মলকুমার সানা বলেন, “আসলে হাসপাতালে রোগী কম থাকায় কর্মী সংখ্যাও কম। মাত্র ৫ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছেন। এত কম কর্মী দিয়ে জঙ্গল কাটা যায় না। তবে রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে কোনও খামতি নেই।” রোগীরা অবশ্য মানছেন না সুপারের সাফাই। |