|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
নিজেকে জাহির করার প্রবণতা নেই কোথাও |
শ্বশুরবাড়ি, হেঁশেল, উনুন, ঠাকুরঘর, সন্তানের জন্মদানের বাইরে মেয়েদের জন্য আর কোনও জগত্ কল্পনা করলেই ‘গেল গেল’ রব উঠত তখন। সময়টা উনিশ শতক। একে বিদেশি শাসক, রক্ষণশীল সমাজ যে কোনও পরিবর্তনের আভাসেই বিপুল ভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠত। লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা হবে এমন ভয়ানক মিথ্যেকে সত্যি বলে চালানো সম্ভব হয়েছিল কারণ বালবিবাহের ফলে অকাল বৈধব্য ছিল সে যুগের নিষ্ঠুর বাস্তব। গোটা শতক জুড়ে তাই এক দিকে সমাজপ্রভুদের তিরস্কার-তাচ্ছিল্য-অনুশাসন, অন্য দিকে সমাজসংস্কারে উদ্যোগী কিছু ব্যক্তিমানুষের প্রয়াসে নারীশিক্ষার সূচনা ও ক্রমবিকাশ।
নিজস্ব প্রেক্ষিতের নানাবিধ অন্তরায় নিজের মতো সামলে উনিশ শতকের মেয়েরা কেউ কেউ নিজের কথা নিজে লেখায় আন্তরিক ভাবে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে মানবীবিদ্যা চর্চার আরম্ভে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চির-প্রান্তবাসী নারীই গবেষণার বিষয়, আর সেই গবেষণার অন্যতম প্রাথমিক উপাদান নারীর আত্মকথন। সেই কারণেই আত্মকথার সংকলনে নিহিত থাকে আকরগ্রন্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। অন্দরের ইতিহাস: নারীর জবানবন্দি (সম্পাদনা ও সংকলন: প্রসূন ঘোষ ও অহনা বিশ্বাস) আপাতত দু’টি খণ্ডে প্রকাশিত (গাঙচিল, প্রথম খণ্ড ৫০০.০০, দ্বিতীয় খণ্ড ৫৫০.০০)। প্রথম দু’টি খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত উনিশ শতকের নারীর আত্মকথা। ভূমিকায় সম্পাদকের বক্তব্য, ‘নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অর্জনের ইতিহাস আর সমগ্র জাতির জাগরণের ইতিহাস সর্বদা সমানুপাতিক।’ ১৮০৯-এ জন্মে রাসসুন্দরী দেবী নারীজীবনকে পিঞ্জরাবদ্ধ দেখেছিলেন। তার পঞ্চাশ বছর পর সুদক্ষিণা সেনের জন্ম। নারীকে সুদক্ষিণা কারাগারে বন্দি মনে করেছিলেন। ‘পিঞ্জর’ ও ‘কারাগার’, এই দু’টি উপমা নারীজীবনের সেই ছবি তুলে ধরেছে, যে ছবি শুধু যিনি লিখেছেন তাঁর নয়, একাধিক প্রজন্মের আত্মকথন। প্রথম খণ্ডে আছে বামাসুন্দরী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, রাসসুন্দরী দেবী, কৃষ্ণভাবিনী দাস, নগেন্দ্রবালা দাসীর রচনা। দ্বিতীয় খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত সারদাসুন্দরী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, নিস্তারিণী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, সুদক্ষিণা সেন, শরত্কুমারী দেব ও বিনোদিনী দাসী। সামাজিকীকরণের গভীর শিকড় সত্ত্বেও মাথা তুলে নিজের কথা বলা, মেয়েদের সামাজিক অবস্থানকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার এক সার্বিক প্রবণতায় সমসময়ের বাস্তব ও অদূর ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার পথনির্দেশ স্পষ্ট। আকরগ্রন্থ হয়ে ওঠার পথ সুগম করেছে বিস্তারিত ভূমিকা ও সম্পাদকীয় টীকা। যদিও সমস্ত রচনাই পূর্বপ্রকাশিত, তবু সব ক’টি সুলভ নয়। দুই মলাটের মধ্যে তাদের সযত্নে ধরে রাখার আর একটি প্রয়াস সাধুবাদযোগ্য।
চন্দ্রকণা সেনের নগণ্য জীবন ও ঠাকুমার খাতা-য় (গাঙচিল, ২২৫.০০) চন্দ্রকণার আত্মকথন ছাড়াও রয়েছে ঠাকুমার খাতা। দু’টি ভিন্ন প্রজন্মের নারীর জীবনযাপন। চন্দ্রকণা ১৯৪৭-এর অগস্টে এক রত্তি তিন বছরের মেয়ে। মা-বাবার একটি মাত্র সন্তান অথচ মা’র সঙ্গে কোথায় যেন দূরত্ব। স্কুলে ইংরেজির প্রিয় শিক্ষিকা মনীষাদির জীবনে তাঁর স্বামীর অত্যাচার ও শেষে মনীষাদির পাগল হয়ে যাওয়া পুরুষের অত্যাচার-অবিচার সম্পর্কে তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না বলে জীবনের চড়াই-উত্রাইতে মাথা সোজা রেখে চলেছিল তাঁর জীবনযুদ্ধ। মৃত্যুর আগে মা’র শারীরিক অবনতি অস্থির করেছিল তাঁকে। মা’র মৃত্যুতে ‘সর্বহারা’ মনে করেছিলেন নিজেকে। সংবেদনশীল চন্দ্রকণা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, ‘হঠাত্ কে যেন একটা ভাঙা টিনের সুটকেশ বারান্দায় উপুড় করে কিছু ঢালল...’। তার থেকেই ছেঁড়া খোঁড়া নোট খাতাটি লুকিয়ে যত্নে হাতে তুলে নিয়েছিলেন চন্দ্রকণা। এটিই ঠাকুমার অর্থাত্ তাঁর স্বামীর ঠাকুমার খাতা। শিশু সন্তানদের ধারাবাহিক মৃত্যু, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি সত্ত্বেও ঠাকুমা ক্রমাগত লিখে গেছেন— কখনও বা কোথায় কত ঋণ, থালা-বাটি বন্ধক কোথায় রেখেছেন অথবা প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকগাথা। গ্রামে তাঁর ‘কবি বউ’ নাম হয়েছিল বিয়ের পদ্য লিখতে দক্ষ ছিলেন তিনি। ওষ্ঠব্রণে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর চন্দ্রকণার স্বামীর জন্মেরও অনেক আগে। ঠাকুমার প্রতিভা, সামাজিক অন্তরায় চন্দ্রকণার কলমে সুস্পষ্ট। কোথাও নেই নিজেকে জাহির করার প্রবণতা।
শ্রীমতী নীরদাসুন্দরী ঘোষের দুঃখের পুটুলী এক বালবিধবার জীবন কথা। ১৯২৩-এ সীমিত সংস্করণে প্রকাশিত হওয়ার এত দিন পর পুনর্মুদ্রিত হল (অব্যয়, ৮০.০০)। গভীর শোক গোপন রেখে হাসিমুখে গৃহকর্মে ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে, ‘দুঃখীর দুঃখে দুঃখী হইবার একটি লোকও কি তাঁহার সৃষ্টির ভিতরে নাই।’ ‘একাদশী’ শীর্ষক শেষ লেখাটিতে বৈধব্যে সমাজ-আরোপিত বিধিনিষেধের নিষ্ঠুরতা অত্যন্ত প্রকট। ক্ষিদে সহ্য করতে না পারা বালবিধবার একাদশীর দিন স্বামীকে মনে পড়া, উপবাসের পর দিন ভাত পেলেই যে তার রাগ পড়বে, সস্নেহে মা’কে সে কথা বাবার মনে করিয়ে দেওয়া ‘হায় ভগবান সেই বাবা মা আজ কোথায়?... দিনে দিনে সকলই ফুরাইয়া গেল। শুধু একাদশীর ব্রতই আমার চিরসাথী রহিল।’ অলোক রায়ের ভূমিকা এই বইয়ের প্রয়োজনীয় প্রেক্ষিতটি তৈরি করে দিয়েছে। |
|
|
|
|
|