|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বাংলা মুদ্রণ-সংস্কৃতির অচেনা দিগন্ত |
ইন্দ্রজিত্ চৌধুরী |
উনিশ শতকের বাংলা ছাপাখানা, আশিস খাস্তগীর। সোপান, ১৪০০.০০ |
ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৮ সালে হুগলি থেকে প্রকাশ করলেন আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ। ‘মুভেবল টাইপ’ বা বিচল হরফে বাংলা মুদ্রণের সেটাই সূচনা। এই হরফ তৈরির পিছনে প্রধান কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে চার্লস উইলকিন্স-কে, যিনি আরও তিনটি বাংলা ফন্ট তৈরি করেন। তবে হ্যালহেডের বইয়ের হরফ নির্মাণে জোসেফ শেফার্ড ও পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকাও যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা আজ আমাদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে গ্রাহাম শ এবং ফিয়োনা রস-এর গবেষণায়। হুগলির পর কলকাতা— বাংলা মুদ্রণ এগিয়েছে দ্রুত গতিতেই। গোলাম মুরশিদ দেখিয়েছেন, আঠেরো শতকের মধ্যেই অন্তত ১৯টি আইনগ্রন্থের বঙ্গানুবাদ আর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ হাজার দুই বাংলা বিজ্ঞপ্তি-বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। সে সময় কলকাতায় অন্তত ১৭টি ছাপাখানা সক্রিয় ছিল। উনিশ শতকে তো জোয়ার এল বাংলা মুদ্রণে, পুরো শতক পরিক্রমায় বাংলা মুদ্রণের সঙ্গে জড়িত ১২৭০টি ছাপাখানার হদিশ দিয়েছেন আশিস খাস্তগীর। এত বিস্তারিত তালিকা এর আগে কেউ দিতে পারেননি। এই সব ছাপাখানার তত্ত্বতালাশই তাঁর প্রকাশিতব্য উনিশ শতকের বাংলা ছাপাখানা বইয়ের মূল উপজীব্য।
হুগলি থেকে কলকাতা, ছাপাখানার সূচনা সাহেবদের হাতেই। ইংরেজি সংবাদ-সাময়িকপত্র ছাপার প্রাথমিক উদ্যোগের সঙ্গে যেমন প্রথম দিকের মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা জড়িত, বাংলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, দেখিয়েছেন আশিস খাস্তগীর। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা বাইবেল, রামায়ণের সঙ্গে মাসিকপত্র ‘দিগ্দর্শন’ আর সাপ্তাহিকপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ শুরু করেন। আশিসের হিসেবে, উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরে ছাপাখানা ছিল ১২২টি, আর পত্রপত্রিকা ৯৭টি। পরের অর্ধশতকে সংখ্যাটা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১১২৬ ও ১০৮৭। কিন্তু শুধু সংবাদপত্র ছেপে ছাপাখানা রক্ষা করা সম্ভব নয়, তাই বই তো বটেই, অন্যান্য ছোটখাট মুদ্রণের কাজও সব প্রেসকেই করতে হত। তা সত্ত্বেও ধারাবাহিক সাফল্যের মুখ খুব কম ছাপাখানাই দেখতে পেয়েছে। শতকের গোড়ায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস বহুবিস্তৃত কর্মকাণ্ডের সূচনা করলেও তৃতীয় দশকেই তা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের উত্তরসূরি ধরা হয় ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেসকে, তারা কিন্তু ১৮১৮-য় শুরু করে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রমরমিয়ে কাজ করে গেছে। দুঃখের কথা, ১৯৭০-এর দশকে এই প্রেস যখন উঠে যায়, তখন তাদের ধাতুর যাবতীয় হরফ গলিয়ে ফেলা হয়। খুব সম্ভবত শ্রীরামপুর মিশনের গোড়ার দিকের হরফও তার মধ্যে ছিল। বাংলা এবং বাংলায় তৈরি অন্য বহু ভাষার হরফের বিবর্তনের এক ধারাবাহিক ইতিহাস আমাদের ঔদাসীন্যে এই ভাবেই নষ্ট হয়ে গেছে।
ছাপাখানার ইতিহাসের নষ্টকোষ্ঠী উদ্ধারে বিপুল পরিশ্রম করেছেন আশিস খাস্তগীর। বাংলা গদ্যে নীতিশিক্ষা, বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ-এর মতো কাজ এর আগেই তাঁর ঝুলিতে রয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষত্, উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির মতো গ্রন্থাগারে বাংলা মুদ্রণের আদি পর্বের নমুনাগুলি স্বচক্ষে দেখার সঙ্গে জেমস লঙ-এর তালিকা, ব্লুমহার্ড-এর ক্যাটালগ, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের তালিকা, বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ ইত্যাদি বহু আকরসূত্র তিনি যত্ন করে দেখেছেন। সেই অনুসন্ধানের ফসল উনিশ শতক জুড়ে বাংলা মুদ্রণের সঙ্গে জড়িত ছাপাখানাগুলির তালিকা। ১২৭০টি ছাপাখানার মধ্যে কলকাতাতেই মিলছে ৯৬৭টি, যার মধ্যে ৩৪২টিকে শনাক্ত করা যায়নি। কলকাতা বাদে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক সীমানায় ১২৯টি, তত্কালীন পূর্ববঙ্গে ১৪৫টি, ভারতের অন্য রাজ্যে ২৭টি এবং লন্ডনে দুটি ছাপাখানা খুঁজে পেয়েছেন আশিস। প্রায় সাড়ে তিনশো পাতার বইয়ে তিনি অধ্যায়ক্রমে সাজিয়ে দিয়েছেন এই তথ্যপুঞ্জ, সঙ্গে রেখেছেন ৬৭০টি ছবি।
কাজটা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট জটিল। বিভিন্ন তালিকা থেকে একই নামের অনেক প্রেসের সন্ধান মিলছে। একই প্রেস আবার বার বার ঠিকানা বদলেছে। মালিকানার হাতবদল তো আছেই। স্থানান্তরের ইতিহাস অন্যান্য সূত্রে স্পষ্ট বোঝা না গেলে ভিন্ন ঠিকানায় একই প্রেস, না নতুন প্রেস, বলা খুব কঠিন। অল্প সময়ের মধ্যে মুদ্রাকর ও প্রকাশকের নাম বদলে যায়, বিভ্রাট সেখানেও। শোভাবাজারে বিশ্বনাথ দেব-এর (দে?) প্রেস সে কালের অন্যতম বিখ্যাত বাংলা মুদ্রণের প্রতিষ্ঠান, কিন্তু বিশ্বনাথ সম্পর্কে তথ্য নিতান্ত অপ্রতুল। রাধাকান্ত দেব-এর ‘স্বীয়যন্ত্রে’ মুদ্রিত শব্দকল্পদ্রুম প্রথম দুটি খণ্ডের মুদ্রাকর বিশ্বনাথ দেবদাস কি তিনিই? এই ‘স্বীয়যন্ত্র’ই বা কোথায় ছিল? আশিস এমন সমস্যায় পড়েছেন আরও অনেক যন্ত্র নিয়েই। সে সব প্রশ্ন সামনে রেখেই এই বইয়ের সাতটি অধ্যায় ও ষোলোটি পরিশিষ্ট তৈরি হয়েছে।
মোফাককার হোসেন খান একই প্রেস থেকে ছাপা বইগুলিকে একত্র করে (যতগুলি তিনি বিদেশে দেখতে পেয়েছেন) বাংলা মুদ্রণের আদি পর্বের এক রকম ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। এখানকার গ্রন্থাগারগুলি ঘেঁটে তেমন কাজ করা হলে প্রেসের চরিত্র, স্থানান্তর, হাতবদল ইত্যাদি নানা তথ্যের জটিলতা হয়ত কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যে সব প্রেস ধারাবাহিক ভাল মুদ্রণের পরিচয় রেখেছে, এ কাজে তাদের ভূমিকা আরও ভাল করে বোঝা সম্ভব হবে অনেক বেশি বই দেখতে পারলে। আশিস ‘উনিশ শতকের বাংলা বই’ নিয়ে কাজ করছেন, তিনি নিশ্চয়ই এই দিকটি খেয়াল রাখবেন।
মুদ্রাযন্ত্রের প্রাযুক্তিক দিকটি দিয়েই আশিস খাস্তগীরের বর্তমান বইটির সূচনা। গুটেনবার্গ-এর কাঠের প্রেস থেকে স্ট্যানহোপ প্রেস হয়ে কলম্বিয়ান, অ্যালবিয়ন, প্ল্যাটেন জবার, স্টিম মেশিন, লাইনোটাইপ-এর বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্য সংক্ষিপ্ত তথ্যে আর ৬০০ ছবিতে খুব যত্ন করে দেখিয়েছেন তিনি। এত মুদ্রাযন্ত্রের ছবি একত্রে পাওয়াটাই দারুণ ব্যাপার। তবে ছবির প্রায় পুরোটাই মুদ্রাযন্ত্র-কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় বইটির ভরকেন্দ্র নিয়ে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। যে হেতু এই বইটি মুখ্যত মুদ্রাযন্ত্রের ইতিহাস নয়, তাই এখানে প্রয়োজন ছিল এই সব মুদ্রাযন্ত্রের কোনগুলি এ দেশে বাংলা বই-পত্রিকা মুদ্রণে উনিশ শতকে ব্যবহৃত হয়েছে, তার অন্তত কিছুটা হদিশ দেওয়ার। লেখার মধ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে তার কিছু উল্লেখ থাকলেও বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। কলকাতায় বা রাজ্যের অন্যত্র এখনও কিছু পুরনো মুদ্রাযন্ত্র টিকে আছে, জয়ন্ত বাক্চির সংগ্রহের অ্যালবিয়ন ছাড়া তার আর কোনও নমুনা এখানে নেই। এর পর আছে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ছাপাখানার আলোচনা, ওপার বাংলার ছাপাখানা, ব্যক্তিগত ছাপাখানা (মুসলমান মালিকানাধীন সহ), বটতলা এবং বহির্বঙ্গ ও বহির্ভারতের ছাপাখানার কথা। ওপার বাংলার ছাপাখানার জেলাওয়াড়ি বর্ণনা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রয়েছে শুধু স্থানগত তালিকা।
পরিশিষ্টগুলি খুব মূল্যবান, বস্তুত এই বইয়ের আসল সম্পদ। নানা দিক থেকে আলো ফেলা হয়েছে বিষয়টির উপর— বিশেষ করে ছাপাখানার কালানুক্রমিক ও ভৌগোলিক বিস্তারের তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এখানে দু-একটি মানচিত্র দরকার ছিল। কারা মুদ্রণ ব্যবসায় নেমেছিলেন, নাম জানছি তাঁদেরও। পত্রপত্রিকার সঙ্গে ছাপাখানার সম্পর্ক এখানে আরও বিস্তারে রয়েছে, স্বপন বসুর সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগের বাইরে আরও শ’দেড়েক পত্রিকার হদিশ। যে সব পত্রিকার প্রেসের নাম মেলেনি, তাদের দীর্ঘ তালিকা বোধহয় প্রাসঙ্গিক ছিল না। সাময়িকপত্রের গবেষকদের কাছে অবশ্য এ তালিকা অমূল্য।
এমন সম্পদ যিনি উদ্ধার করে দেন, তাঁর কাছে প্রত্যাশাটাও অশালীন রকম বেড়ে যায়। বইটির নামে ‘ছাপাখানা’ কথাটি রয়েছে, কিন্তু আলোচনায় এসেছে শুধু মুদ্রাযন্ত্রের কথা। ছাপাখানা তো শুধু মুদ্রাযন্ত্র বা তার স্বত্বাধিকারীর কথা নয়, তার মধ্যে রয়েছে মুদ্রণ-সংস্কৃতির হাজারো দিক। কম্পোজিটার থেকে প্রুফরিডার, হরফ-নির্মাতা থেকে জেলদগর, এঁদের কথা তো একেবারেই এল না। তা হলে কেন
‘অন্ধকার ছাপাখানার
সকল অমলকান্তিকে
যারা রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’,
তাঁদের এই বই উত্সর্গ করলেন আশিস খাস্তগীর? |
|
|
|
|
|