বারাসত জেলা হাসপাতালের মহিলা সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে বছর উনিশের মেয়েটির বেডের পাশে কয়েক জন বন্দুকধারী পুলিশ কর্মী দাঁড়িয়ে। বারাসত থানার আইসি পরেশ রায় নিজেও ঘোরাঘুরি করছেন ওয়ার্ডে। শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি শুরু হয়েছে কাউন্সেলিং। শুক্রবার বিকেলে হাসপাতালে এসে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে গিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। পুলিশ মোতায়েন হয়েছে মেয়েটির বাড়িতে।
মধ্যমগ্রাম কাণ্ডের পরে রাজ্য সরকার নানা ভাবে অস্বস্তিতে পড়ায় পুলিশ-প্রশাসন আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না হাবরার তরুণীকে নিয়ে। মঙ্গলবার রাতে হাবরা থানার বিড়ার বাসিন্দা ওই তরুণীকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। গত বছর ২৫ জুন (ওই মাসের ৭ তারিখেই ঘটে গিয়েছে কামদুনির ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা) ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় মেয়েটিকে। সঞ্জয় ব্যাপারি নামে অভিযুক্ত প্রতিবেশী যুবককে পিটিয়ে পুলিশে দেয় জনতা। নভেম্বর মাসে জামিনে ছাড়া পায় সে। অভিযোগ, সঞ্জয়ের মা শ্যামলী ও ভাই বাপি মামলা প্রত্যাহারের জন্য নানা ভাবে ভয় দেখাচ্ছিল তরুণীকে। খুনের হুমকিও দেয়। তরুণীর পরিবারের দাবি, মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। শ্যামলী ও বাপিকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করে পুলিশ। শুক্রবার বারাসত আদালতের বিচারক তাদের ১৪ দিন জেলহাজতে রাখার নির্দেশ দেন। |
মেয়েটির শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সুপার সুপ্রিয় মিত্র। মধ্যমগ্রামে একাধিক বার গণধর্ষিতা কিশোরীকেও ভর্তি করা হয়েছিল বারাসত হাসপাতালে। সে সময়ে মেয়েটির চিকিৎসা ঠিক মতো হয়নি বলে সমালোচনা করে রাজ্য মহিলা কমিশন। মেয়েটিকে পাঠানো হয় এমআর বাঙুর হাসপাতালে। সেই ঘটনা মাথায় রেখেই এ বার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক সচেতন। চিকিৎসক সুবীর সাহা জানান, ছোটবেলায় মেয়েটির হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ফলে কিছুটা দুর্বল মেয়েটি। আক্রমণের ঘটনার পরে মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েছিল। মেয়েটির কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বে আছেন মৌমিতা মণ্ডল। তিনি বলেন, “ও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। হাসপাতালের বেড ছেড়ে নড়তেই চাইছে না। বাড়ি ফেরা তো অনেক দূরের কথা।”
মেয়েটির পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, সঞ্জয় ও তার পরিবার সম্পর্কে এলাকার সকলেই তিতিবিরক্ত। এর আগেও এক মহিলার শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল বছর ছাব্বিশের ওই যুবকের বিরুদ্ধে। বছর ছ’য়েকের এক নাবালিকার সঙ্গেও অশ্লীল আচরণের অভিযোগ ওঠে। পাড়ার লোক মারধর করে তাকে এলাকা ছাড়া করেছিল। ফিরে এসে কিছু দিন চুপচাপ থেকে ফের স্বমূর্তি ধারণ করে সঞ্জয়। প্রতিবেশী ওই তরুণীর বাড়িতে রাতের অন্ধকারে চড়াও হয়। মেয়েটির ভাই বাধা দিতে গেলে তাকে ভোজালি দিয়ে কোপায়।
মেয়েটির মা বলেন, “যাতায়াতের পথে দেখা হয়েই যেত শ্যামলী আর তার ছোট ছেলের সঙ্গে। তারা মেয়েকে নানা ভাবে ভয় দেখাত। বলত, তোর জন্যই ছেলেটার সর্বনাশ হল। তুই মরতে পারিস না? মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিত ওরা। টাকার লোভও দেখিয়েছিল।” এলাকার লোকজন জানালেন, নভেম্বর মাসে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে সঞ্জয় একবার এলাকায় ফিরে মেয়েটিকে দূর থেকে কোদাল হাতে শাসিয়েছিল।
পরিবারের দাবি, জুন মাসের ঘটনার পর থেকেই তরুণী মনমরা হয়ে থাকতেন। স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন। হুমকি দেওয়ার অভিযোগ হাবরা থানায় মৌখিক ভাবে জানায় পরিবারটি। পুলিশ এসে বার কয়েক ঘুরে যায় এলাকায়। শ্যামলীদের বাড়িতে গিয়ে ধমকও দিয়ে আসে। মেয়ের মা জানান, হাবরার আইসি নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েকে। বলেছিলেন, প্রয়োজনে যেন সে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারপরেও মেয়ে ভয়ে ভয়ে থাকত। মেয়েটির বাবা কর্মসূত্রে থাকেন দমদমে। ভাইও থাকে অন্যত্র। বাড়িতে একা মা-মেয়ে। এর ফলে আরও মেয়েটির ভয় কাটতে চাইছিল না বলে জানিয়েছেন মা।
জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কাছে এ দিন মেয়েটি বলেছে, সে পড়াশোনা করতে চায়। তার চিকিৎসা এবং অন্যান্য খরচের দায়িত্ব নেবেন বলে আশ্বাস দেন মন্ত্রী। মেয়ের মাকে স্থানীয় পঞ্চায়েতে চাকরি করে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “আমরা সব রকম ভাবে পরিবারটির পাশে আছি।” মন্ত্রীর নির্দেশে পরিবারের সদস্যদের এ দিনই অন্ত্যোদয় কার্ড দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, “মেয়েটি বাড়ি যেতে ভয় পাচ্ছে। ও চাইলে হোমে রাখার ব্যবস্থা করতে পারি।”
সঞ্জয়ের হাত থেকে দিদিকে বাঁচাতে গিয়ে গলায় ৯টি সেলাই পড়েছিল তরুণীর পিঠোপিঠি বয়সী ভাইয়ের। তার আক্ষেপ, “আমার আর বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা এ ভাবে দিদির উপরে চাপ সৃষ্টি করে যাবে ভাবতে পারিনি।”
|