তখনও হাসপাতালে ফেরেননি সুন্দরবন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের অধিকর্তা অরুণ সেন।
মামণির রান্নাঘরে গ্যাসে চা চাপানো। পাশে তক্তার উপরে পরিপাটি বিছানা পাতা।
কে থাকে এই ঘরে?
“এটা মেয়েদের ঘর। হাসপাতালে যে মেয়েরা কাজ করেন, তাঁরাই এই ঘরে সকলে মিলে থাকেন। বিছানা করা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা, রান্না করার জন্য দু’জন করে পালা পড়ে।”
২০০৩ সালে উত্তর ২৪ পরগনার সরবেড়িয়ায় গড়ে উঠেছিল সুন্দরবন শ্রমজীবী স্বাস্থ্যপ্রকল্প। উদ্দেশ্য, গরিব মানুষকে অল্প টাকায় চিকিত্সা দেওয়া। হাসপাতালে থেকে পালা করে দিন-রাত রোগীদের দেখভাল করেন মামণি, কাকলি, নমিতা, পূর্ণিমা, রৌশেনারারা। সকলেরই বাড়ি উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গায়। হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীর বেতনেই তাঁরা স্বনির্ভর।
পাড়ার মেয়েই যখন হয়ে ওঠে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতালে আসা গরিব মানুষগুলো ভরসা পায়। “এক বার পাশের গ্রামের এক মেয়ের প্রসব হওয়ার কথা। এখানে তো বেশির ভাগ প্রসব বাড়িতেই হয়। কিছু অভিজ্ঞ ধাই প্রসব করান। বেশ রাতে মেয়েটির প্রসব হওয়ার কথা। আমরা এখান থেকে শুনছি, একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। বাড়ি থেকে ওকে হাসপাতালে আসতে দেবে না। আমি হাসপাতালের কয়েক জনকে নিয়ে গেলাম ওদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি, খুব খারাপ অবস্থা। রক্তে মাখামাখি। কিন্তু জোর করে হাসপাতালে তো আনতে পারি না। তাই বাড়িতেই যতটা সম্ভব পদ্ধতি মেনে প্রসব করালাম। একেবারে নিজের ঝুঁকিতে”— বলেন মামণি। |
শ্রমজীবী হাসপাতালেও কিন্তু প্রসব করানোর ব্যবস্থা নেই। তবু স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতযশই অনেক সময় কাজে লেগে যায়। মামণির মনে পড়ে, “তখন সবে কিছু দিন হল এখানে এসেছি। এক অন্তঃসত্ত্বা কিডনির সমস্যা নিয়ে ভর্তি ছিলেন। হঠাত্ এক রাতে তাঁর প্রসবযন্ত্রণা ওঠে। অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি নেই। তাঁর স্বামী ব্যবস্থা করে ওঠার আগেই প্রসব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বাধ্য হয়ে আমরাই প্রসব করালাম। খুব ভয় করছিল। কিন্তু যখন প্রসব করাতে পারলাম, কী আনন্দই না হয়েছিল!”
স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে এলাকার মেয়েদের রোগের ধরন-ধারণও মামণিদের অনেকটাই জানা। তাঁরা জানান, এখানকার মেয়েদের রক্তাল্পতা তো রয়েইছে। তার সঙ্গে অপুষ্টি আর স্ত্রীরোগও যোগ হয়েছে। মামণির মতে, “মাছ চাষের জন্য জমি দিয়ে অনেকেই বেকার হয়ে গিয়েছে। আগে সাধারণ শাকসব্জি নিজেদের জমি থেকেই উঠে আসত। এখন প্রায় সব কিনে খেতে হয়। ফলে, পুষ্টিকর খাবার পায় না অনেকেই। এমনিতেই বহু মেয়ের রক্তাল্পতা থাকে। এখানে তা আরও বেশি। তার সঙ্গে চর্মরোগও রয়েছে। নোনা জলে কাজ করতে-করতে অনেকেরই হয়ে যায়। ”
হাওড়ার চেঙ্গাইলে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ডাক্তারদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই মেয়েরা। ২০০৮-এর ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সাধারণ চিকিত্সার জন্য পাশ করা ডাক্তারের প্রয়োজন নেই জানিয়ে সেই সংস্থার সম্পাদক চিকিত্সক পুণ্যব্রত গুণ বলেন, “সোভিয়েতে প্রথম সার্বিক স্বাস্থ্য প্রকল্প শুরু হয়েছিল। সেখানকার ‘বেয়ার ফুট’ চিকিত্সকেরা কেউ পাশ করা ছিলেন না। আমাদের দেশের আইনে ডাক্তার ছাড়া কেউ ওষুধ লিখতে পারেন না। কিন্তু এটাও সত্যি, সারা দেশের মানুষের জন্য যত পাশ করা ডাক্তার দরকার তা নেই, অদূর ভবিষ্যতেও তা হবে না। তাই সাধারণ মানুষকে কিছু প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করছি আমরা।”
ওই প্রশিক্ষণের মেয়াদ দু’মাসের। লক্ষ্য, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তেরা যাতে নিজের নিজের এলাকায় ন্যূনতম পরিষেবাটুকু দিতে পারেন। তবে তাঁরা যে পরিষেবা দিচ্ছেন, তা পাশ করা ডাক্তারের তত্ত্বাবধানেই হচ্ছে। পুণ্যব্রতবাবুর মতে, “পুরো চিকিত্সা ব্যবস্থাতেই এই স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা অনেকটাই।”
প্রথম দিকে ডাক্তার না থাকলে কী করবেন বুঝে উঠতে পারতেন না স্বাস্থ্যকর্মী মেয়েরা। এখন উল্টোটাই হয়। শহরে বা সরকারি হাসপাতালে যেখানে রোগীর আত্মীয়রা প্রথমেই ডাক্তারের খোঁজ করেন, শ্রমজীবীতে প্রথম ডাক পড়ে মামণি-নমিতাদের। এলাকার মানুষ যে এই মেয়েদের শুধু বিশ্বাস করেন বা ভরসা করেন তাই নয়, ভালওবাসেন। প্রতি বছর শীতে সরবেড়িয়ায় একটা উত্সব হয়। হাসপাতালের সামনের মাঠে গান-বাজনা আর গ্রামের সবাই মিলে এক সঙ্গে খাওয়া। পুরোটাই গ্রামবাসীর দেওয়া চাঁদায়। “আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসি। যে যেমন পারে দেয়। কেউ আলু, কেউ চাল। যে দিতে পারে না, সে-ও আসে। আমরা ওই দিনটায় এক সঙ্গে সবাই মিলে খাই। এক বার তো বরের সঙ্গে ঝগড়া করে পুরনো এক রোগীর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম”— বলতে বলতে হেসেই গড়িয়ে পড়েন মামণি। তার পরে যোগ করেন, “প্রথম-প্রথম কাজটা করতে ভয় করত। এখন আর করে না। বরং মনে হয়, কাজটা করতে না পারলে নিজের কাছেই নিজে হেরে গেলাম।” |