শয্যার অভাবে মুমূর্ষু রোগীদের যাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে যেতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে ‘বেড ব্যুরো’ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছিলেন, পরিকল্পনা সফল হলে রোগী-ভর্তির ক্ষেত্রে গোটা দেশকেই দিশা দেখাতে পারবে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু ঘোষণার পরে বছর ঘুরলেও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের অসহযোগিতাই এ জন্য দায়ী।
কেমন ছিল ‘বেড ব্যুরো’র পরিকল্পনা? স্থির হয়েছিল, নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে শয্যা না থাকলে অন্য যে সব ওয়ার্ডে রোগীর চাপ কম, সেখানে ভর্তি করা হবে রোগীদের। সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকেরা ওই সব ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী দেখে আসবেন। শুধু তা-ই নয়, কোন হাসপাতালে কোন কোন ওয়ার্ডে মাসে গড়ে কত শয্যা খালি পড়ে থাকে, তার তালিকাও তৈরি করার কথা হয়েছিল। কলকাতার হাসপাতালগুলি থেকে এই বিষয়টি শুরু করার কথা ছিল। তার পরে ধাপে ধাপে জেলাতেও তা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা। আপাতত সবটাই অনিশ্চিত।
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা বিষয়টি ব্যাখা করেছেন এই ভাবে ধরা যাক, অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে রোগীর প্রবল চাপ। সেখানে মেঝেতেও উপচে পড়ছে রোগীর ভিড়। কিন্তু চক্ষু বিভাগে চাপ তুলনামূলক ভাবে কম। বেশি কিছু শয্যাই সেখানে খালি পড়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অর্থোপেডিক বিভাগের ‘এক্সটেন্ডেড ওয়াডর্’ হতে পারে চক্ষু বিভাগ। একই রকম ভাবে সার্জারি বিভাগে শয্যা খালি না থাকলে সেই রোগীদের ভর্তি করা হতে পারে অন্য কোনও তুলনামূলক ভাবে খালি ওয়ার্ডে। পরে সার্জারি বিভাগে শয্যা খালি হলে সেখানে তাঁদের স্থানান্তরিত করা হবে। এর ফলে ‘শয্যা নেই’-এর অজুহাতে রোগীদের হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া আটকানো যাবে বলে মনে করা হয়েছিল।
তা হলে কেন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা গেল না? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চিকিৎসকদের অনেকেই অন্য ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী দেখতে রাজি হচ্ছেন না। বলছেন, এ ভাবে কাজ করতে অনেক অসুবিধা হবে। রোগী সংক্রান্ত তথ্য রাখার ক্ষেত্রেও জটিলতা হতে পারে। বাস্তব কিছু সমস্যার কথা আমরা মেনে নিচ্ছি। সে তো গোড়ায় যে কোনও নতুন জিনিস চালু করতে গেলেই হয়ে থাকে। সে জন্য তো পরিকল্পনা বাতিল হয় না।” তবে চিকিৎসকদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার আগেই এমন একটি প্রকল্প চালু করলে আখেরে রোগীরাই যে সমস্যায় পড়বেন, সে কথাও মেনে নিয়েছেন তিনি। সেই কারণেই প্রকল্পটি আপাতত মুলতুবি রয়েছে।
কেন ‘বেড ব্যুরো’ সম্পর্কে এত অনীহা চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের? এসএসকেএমের অর্থোপেডিক বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “প্রকল্পটা অবাস্তব। এক এক বিল্ডিংয়ে এক এক রোগী থাকলে কোনও চিকিৎসকের পক্ষে সবাইকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। তার উপরে পান থেকে চুন খসলে তখন রোগীর বাড়ির লোকেরা চড়াও হবেন আমাদের উপরেই।” কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “সরকার যদি চিকিৎসকদের গিনিপিগ করে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে চায়, তা আমরা হতে দেব না। বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে ছুটে ছুটে রোগী দেখা অসম্ভব।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, শুধু চিকিৎসকদের অনীহা নয়, হাসপাতালকর্মীদের একটা অংশও এর বিরোধিতা করছেন। কেন? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষকর্তার কথায়, “বহু ক্ষেত্রেই হাসপাতালে শয্যা নেই বলে জানিয়ে রোগীকে আশপাশের কোনও ছোটখাটো বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করেন ওই সব কর্মী। ওই সব হাসপাতালের সঙ্গে তাঁদের কমিশনের বন্দোবস্ত থাকে। বেড ব্যুরো-র ধারণাটা বাস্তবায়িত হলে হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরানো এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যাবে। এতে আখেরে অসুবিধা তো ওই সব কর্মীরই। তাঁরাই অনেককে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে উস্কাচ্ছেন বলে আমাদের কাছে খবর।” হাসপাতালের কর্মী ইউনিয়নগুলি অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের কর্মী ইউনিয়নের নেতা রাজেন মল্লিক বলেন, “সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। রোগীস্বার্থের বিষয়গুলি নিয়ে আমরা কেন কথা বলব? ওটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। আমরা নিজেদের এক্তিয়ারটা বুঝি।” জেলার এক মেডিক্যাল কলেজের কর্মী ইউনিয়নের নেতা তাপস সমাদ্দার বলেন, “ডাক্তাররা নিজেদের দায় এড়াতে ব্যাপারটা আমাদের উপরে চাপানোর চেষ্টা করছেন। ক্ষমতা থাকলে ওঁরা অভিযোগ প্রমাণ করে দেখান।”
স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, এখনই এই প্রকল্পকে ঠান্ডা ঘরে পাঠাতে চান না তাঁরা। বরং কোন পথে কাজ শুরু করলে সব দিকই রক্ষা হয়, সেটাই ভাবা হচ্ছে।
বহু বছরের আপত্তি-প্রতিরোধ ভেঙে অবশেষে বুধবার থেকে ইমার্জেন্সি বিভাগ চালু করা সম্ভব হয়েছে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি-তে। ঠিক সে ভাবেই অদূর ভবিষ্যতে কোনও এক সময়ে বেড ব্যুরোর পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হবে, এমনই আশায় রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। |