দেশের আইন বলছে, কিডনি বিক্রি করা যায় না। কিন্তু কোনও নিকট আত্মীয়কে তা দান করা যায়। আইনের এই সুযোগকে কাজে লাগাতেই ‘আত্মীয়’ তৈরি করার দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজ্যে। কাউকে আত্মীয় সাজিয়ে টাকার বিনিময়ে তাঁর কাছ থেকে কিডনি কিনে চড়া দামে তা বিক্রি করে ওই সব চক্র। সম্প্রতি কলকাতায় এমনই একটি আম্তঃরাজ্য কিডনি-চক্রের হদিস পেয়েছে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রের খবর, কলকাতার ই এম বাইপাসের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালও এর সঙ্গে যুক্ত। ওই সব হাসপাতালে গত তিন বছরে কয়েকশো কিডনি প্রতিস্থাপনের নজির রয়েছে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পল্লবকান্তি ঘোষ (অপরাধ দমন) জানিয়েছেন, আন্তঃরাজ্য কিডনি-চক্রের হদিস মেলায় বিষয়টি রাজ্যের স্বাস্থ্য ভবনের নজরে আনা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে গেলে সরকারি অনুমতি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। এই বিষয়টি দেখভালের জন্য রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের একটি কমিটিও রয়েছে। সেই কমিটিকেও বিষয়টি বিশদে জানানো হয়েছে।
কেমন ভাবে চালানো হয় ওই কিডনি-চক্র?
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এই ক্ষেত্রে যাঁর কিডনি প্রয়োজন, তাঁর আত্মীয় হিসেবে একটি নকল পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। তাতে বহু ক্ষেত্রে পুলিশ বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সই ও স্ট্যাম্প থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই সব সই ও স্ট্যাম্প জাল করা হয়। ওই শংসাপত্র দেখিয়েই কিডনি ‘দান’ করার সরকারি অনুমতি নেওয়া হয়। এর পিছনে চলে মোটা টাকার লেনদেন। গত অক্টোবর মাসে লেক থানা এলাকার একটি গেস্ট হাউস থেকে রাকেশকুমার যাদব নামে এক ব্যক্তির পচাগলা মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল সেখানকার পুলিশ। ময়না-তদন্ত করতে গিয়েই চিকিৎসকের চক্ষু চড়কগাছ। তিনি দেখেন, ওই ব্যক্তির শরীরে একটি কিডনিও নেই। কোথায় গেল ওই কিডনি?
এরই তদন্তে নেমে একটি কিডনি পাচার চক্রের হদিস পায় পুলিশ। ঘটনায় ধৃতকে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ বেশ কিছু রাজ্যে ছড়িয়ে আছে এই চক্রের জাল। হাতেনাতে পাকড়াও করতে বিভিন্ন রাজ্যে গোয়েন্দা দলও পাঠানো হয়েছে।
ধৃত অভিযুক্তদের বেশির ভাগই রাঁচি ও পটনার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সমস্তিপুরের বাসিন্দা রাকেশকুমার যাদবের কাছ থেকেও টাকা দিয়ে কিডনি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পরে টাকাপয়সার গোলমালের জেরে তাঁকে খুন করা হয়। এই ঘটনাতেও যুক্ত ওই পাচার-চক্রের লোকজনই। দাতার হদিস দেওয়া থেকে হাসপাতাল ঠিক করে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সব কিছু দালালরাই করাত। বিনিময়ে তারা পেত মোটা অঙ্কের টাকা।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন আন্দোলনে যুক্ত সমাজকর্মী ব্রজ রায় জানিয়েছেন, ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এক নির্দেশিকা জারি করেছিল, যাতে স্পষ্ট বলা রয়েছে, অসুস্থকে সুস্থ করতে শুধুমাত্র নিকট আত্মীয়েরাই অঙ্গ দান করতে পারবেন। তবে সে ক্ষেত্রেও সরকারি অনুমতিপত্রের প্রয়োজন। ওই অনুমতি মেলার কথা স্বাস্থ্য ভবন থেকে। অথচ সেখানেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধে চলছে ওই লেনদেন।
সমস্যা যে রয়েছে, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা (ডিএমই) ও চিকিৎসক সুশান্ত বন্দোপাধ্যায়ও।
সুশান্তবাবু বলেন, “দাতা আমাদের কাছে যে পরিচয়পত্র জমা দিয়ে থাকেন, শুধুমাত্র সেটাই আমরা খতিয়ে দেখতে পারি। সেটি নকল কি না, তা জানতে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়।”
আর এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকেরা। নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদার বলেন, “কোনও গাফিলতি ধরা পড়লেই প্রথমে তার দায় বর্তায় চিকিৎসকের উপরে। কিন্তু এক জন চিকিৎসকের পক্ষে কখনও কিডনি-দাতার ঠিকুজি খতিয়ে দেখা সম্ভব নয়। অন্যান্য রাজ্যে এই দায়ভার দেওয়া থাকে এই সংক্রান্ত একটি কমিটির উপরে। এ রাজ্যে ছবিটা ঠিক উল্টো।”
অভিজিৎবাবু জানান, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ ছাড়াও দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে ‘হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন’ এক হওয়া উচিত। অন্যথায় কিডনি প্রতিস্থাপন সফল হয় না। আর বহু ক্ষেত্রে গোপনে করতে গিয়ে এ সব দেখাও হচ্ছে না। ফলে মৃত্যু ঘটছে। অভিযোগ, ২০০৮ সালে ই এম বাইপাসের একটি হাসপাতালে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন না করানোর জেরে মৃত্যু হয়েছিল এক জন কিডনি গ্রহীতার। তখনও মিলিয়ে দেখা হয়নি এই সমস্ত বিষয়ের একটিও।
কিডনি চক্রের সঙ্গে চিকিৎসকদের একাংশের যোগসাজশের অভিযোগও রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। সে ব্যাপারেও চিকিৎসকেরা সরব। নেফ্রোলজিস্ট দিলীপ পাহাড়ি বলেন, “কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগে হাসপাতাল থেকে দাতাকে পাঠানো হয় স্বাস্থ্য ভবনে। আইনত দাতা কিডনি দিতে পারবেন কি না, তা দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ভবনের। সে বিষয়ে গাফিলতির দায় নিতে হবে স্বাস্থ্য দফতরকেই।”
তবে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা এই অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “ওঁদের উচিত ঠিকমতো খোঁজখবর নিয়ে তবেই কোনও এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা। আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ রাজ্যেরই এমন কোনও কমিটি নেই। তাই অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে দাতারা অঙ্গ দেওয়ার জন্য কোনও অনুমতিই পান না। আমাদের রাজ্যে এমন কমিটি রয়েছে বলেই অন্যান্য রাজ্য থেকে দাতারা এ রাজ্যে এসে অস্ত্রোপচার করান।” |