সরকারি ছুটির দিন কোনও সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সদ্যমৃত নিকটাত্মীয়ের দেহদান করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়াটাই কি অলিখিত নিয়ম? এই প্রশ্ন তুলে স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দিয়েছেন উত্তর কলকাতার আহিরীটোলার আঢ্য পরিবার।
তিন বছর আগে দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠতম সদস্যা বীণাপাণি দেবী। তাঁর পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গত ১ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার এক নার্সিংহোমে বীণাপাণিদেবীর মৃত্যু হয়। এর পরে কলকাতার চার-চারটি মেডিক্যাল কলেজে যোগাযোগ করা সত্ত্বেও ৯০ বছরের বীণাপাণি দেবীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করা যায়নি। সব হাসপাতাল থেকে একই কথা শুনতে হয়েছে ‘সরকারি ছুটির দিন দেহ নেওয়া যাবে না।’
মৃতার নাতি আসীম আঢ্য বলেন, “ওই অবস্থায় আমরা বাড়ি সামলাব নাকি হাসপাতালে-হাসপাতালে দৌড়বো? পরিস্থিতি যদি এই রকমই হয়, তা হলে স্বাস্থ্য দফতর বরং বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করুক যে ছুটির দিন দেহদান করা যাবে না।”
পয়লা জানুয়ারির তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আঢ্য পরিবারের সদস্যেরা জানিয়েছেন, বুধবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ বীণাপাণি দেবী মারা যান। তার পরেই দেহদানের কাগজপত্র সব বার করে দক্ষিণ কলকাতার যে সংস্থার কাছে দেহদানের অঙ্গীকার করা ছিল, সেখানে জানানো হয়। সংস্থার কর্তারা তাঁদের আরজিকর হাসপাতালে যেতে বলেন।
ডেথ সার্টিফিকেট পেতে তখনও ঘণ্টা চারেক দেরি ছিল। তার মধ্যেই স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পরিবারের কিছু সদস্য আরজিকর হাসপাতালে ব্যবস্থা করতে যান। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান ডি আশিসের কথায়, “আরজিকরে তখন পুরো ছুটির মেজাজ। কর্তারা কেউ নেই। কোথায় যাব, কার সঙ্গে কথা বলব কেউ বলতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত ইমার্জেন্সির এক জন ডাক্তারবাবুকে বলতে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ‘ছুটির দিন অ্যানাটমির ডাক্তারবাবুরা থাকেন না। কোনও দান করা দেহ নেওয়া হয় না।’ তখন আমরা দেহটি হাসপাতালের মর্গে রাখতে বলি। কিন্তু ওঁরা রাজি হন না। অগত্যা আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হই।”
এর পরে দেহদান আন্দোলনে জড়িত দক্ষিণ কলকাতার এক সংস্থার তরফে একে-একে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে যোগাযোগ করা হয়। ওই সংস্থার প্রধান ব্রজ রায় বলেন, “ছুটির দিন সরকারি হাসপাতালে দান করা দেহ ফিরিয়ে দেওয়া প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যে হাসপাতালেই ফোন করলাম সেখানেই জানাল, ছুটির দিন চিকিৎসক নেই, ডোম ছুটিতে। দেহ নেওয়া যাবে না।” তিনি আরও বলেন, “মেডিক্যাল আর ন্যাশনাল মেডিক্যাল বলেছিল, ১১টার মধ্যে দেহ আনতে পারলে মর্গে রাখা যাতে পারে। তার চেয়ে দেরি হলে হবে না। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। কারণ, ডেথ সার্টিফিকেট পেতেই সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে। আর এই ভাবে সময় বেঁধে দেওয়া হবে কেন? নিয়ম হল, যখন দেহ আসবে, তখনই তা নিতে হবে।”
কেন পয়লা জানুয়ারি দেহ নিতে আপত্তি জানাল সরকারি হাসপাতাল? আরজিকর হাসপাতালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যালের কথায়, “যে কোনও সরকারি ছুটির দিন সরকারি হাসপাতালে শুধু আউটডোর আর ইমার্জেন্সি চালু থাকে। অন্য বিভাগগুলিতে ছুটি থাকে। লোকজন থাকে না। এক জন ডোমের উপরে দান করা দেহ গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া থাকে। কোনও কারণে সে হাসপাতালে না-থাকলে মুশকিল হয়। অন্য কেউ দেহ নিতে রাজি হয় না।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ীও জানান, ছুটির দিন কোনও দেহ দান করা হলে তখনকার মতো এক জন ডোম দেহটি নিয়ে হাসপাতালের মর্গে রাখেন। পরদিন তাতে রাসায়নিক দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু ডোমের এত আকাল যে, ছুটির দিন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেহেতু ছুটির দিন তাই অ্যানাটমির যে ক’জন ডাক্তারবাবু আসেন তাঁরাও মেরেকেটে দুপুর ১২টা পর্যন্ত থাকেন। তার পরে দেহ এলে কেউ দায়িত্ব নিতে চান না।”
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সুপার পার্থপ্রতীম প্রধানের বক্তব্য, “বিষয়টি জানি। ডোমের আকাল এর কারণ। ছুটির দিনে এক জন ডোমের উপরে এই ধরনের দান করা দেহ নিয়ে মর্গে রাখার দায়িত্ব থাকে। কিন্তু ১ তারিখ সেই ডোমেরও ২টোর পর বাড়ির লোককে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তাই তিনি বলেছিলেন, ১২টার মধ্যে দেহ এলে সেটা মর্গে রাখা যাবে। তা হয়নি। ফলে আর দেহ নেওয়া যায়নি।” |