বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে ময়না-তদন্ত মাসের পর মাস আটকে থাকছে। সেই ঘাটতি মেটাতে এ বার ডাক্তারদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা ভাবছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর।
এবং এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য-কর্তাদের প্রাথমিক যা পরিকল্পনা, তা হল ছ’মাসের একটি ‘মেডিকো-লিগ্যাল অটোপ্সি সার্টিফিকেট কোর্স’ চালু করা। ওঁদের দাবি, জেলায় জেলায় নিযুক্ত বিভিন্ন শাখার সরকারি ডাক্তারদের মধ্যে থেকে কয়েক জনকে বাছাই করে এই তালিম দিয়ে ময়না-তদন্ত করানোর ব্যবস্থা হতে পারে। এতে যোগ্য চিকিৎসকের অভাব মোকাবিলার পাশাপাশি বকেয়া ময়না-তদন্তের বোঝাও কমানো যাবে বলে স্বাস্থ্য-কর্তাদের আশা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড়া উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শদাতা কমিটির রিপোর্টে এমনই সুপারিশ রয়েছে। যদিও বাস্তবে সিদ্ধান্তটি কতটা কার্যকর হবে, কিংবা এর জেরে ময়না-তদন্ত নিয়ে নতুন জটিলতা দেখা দেবে কিনা, ইতিমধ্যে সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। |
ফরেন্সিক মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে পশ্চিমবঙ্গে ময়না-তদন্তের হতশ্রী দশা নতুন কিছু নয়। বিশেষ বিশেষ ঘটনায় অবশ্য প্রশাসনের নির্দেশে ঝড়ের গতিতে পোস্ট মর্টেম হয়ে যায়, ঝটিতি রিপোর্টও চলে আসে। কিন্তু প্রচারের আলো পড়া ওই সব ‘বিশেষ’ ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে থাকে অসংখ্য জলে ডোবা, সাপে কাটা, আগুনে পোড়া কিংবা পথ দুর্ঘটনায় মৃতের ময়না-তদন্ত রিপোর্ট। ফলে মৃতের পরিজনেরা অফিসের পাওনা-গন্ডা পান না, বিমার টাকা হাতছাড়া হয়, পিছিয়ে যায় বিচার-প্রক্রিয়াও।
এমতাবস্থায় গত জুনে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, তিন দিনের মধ্যে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট তৈরি করে ফেলতে হবে। কিন্তু তা মানা যায়নি। বাস্তবে এখন বহু ক্ষেত্রেই হাতে-নাতে ময়না-তদন্তের কাজটা করে থাকেন মর্গের ডোমরা, কাগজে-কলমে যা মেনে নেওয়া সরকারি কর্তাদের পক্ষে প্রবল অস্বস্তির। পরামর্শদাতা কমিটির চেয়ারম্যান সুব্রত মৈত্র বলেন, “ফরেন্সিক মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ কম। ছ’মাসের কোর্স করালে মেডিক্যাল অফিসারেরাই কাজটা করতে পারবেন। তাঁরা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত না-হলেও ময়না-তদন্ত হয়ে যাবে।” রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর অভিমত, “ময়না-তদন্ত সময়ে শেষ করাটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তো রাতারাতি তৈরি করা যাবে না! এমন ব্যবস্থা চালু হলে তাই সুবিধা হয়।”
বস্তুত ফরেন্সিক মেডিসিনের পাঠ নেওয়ার ব্যাপারে মেডিক্যাল পড়ুয়াদের মধ্যে প্রবল অনীহাও কাজ করে বলে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন। ওঁদের বক্তব্য, রাজ্যে ফরেন্সিক মেডিসিনের এমডি কোর্সে ১৩টি আসন। কিন্তু অনেকে তাতে ভর্তি হয়েও পরে অন্য বিষয়ে এমডি করার সুযোগ পেলে ছেড়ে চলে যান। ফলে বিশেষজ্ঞ তৈরিই হয় অনেক কম সংখ্যায়। তা ছাড়া পরিকাঠামোর চিরাচরিত হাহাকার তো রয়েইছে। কী রকম?
কলকাতা ও বিভিন্ন জেলার ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, খাস কলকাতার দু’-একটা জায়গা বাদ দিলে সুষ্ঠু ময়না-তদন্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কার্যত কোথাওই নেই। বহু মর্গে এসি বিকল। স্টেনোগ্রাফারের পদ থাকলেও লোক থাকে না। যে ডাক্তার কাঁটাছেঁড়া করছেন, তিনিই নোট নিচ্ছেন, তিনিই পরে রিপোর্ট লিখছেন। বিশেষ মতামত দিতে গিয়ে দরকারে তাঁকেই টাইপ করতে হচ্ছে। মোমিনপুর মর্গের ইনচার্জ উমাপ্রসন্ন ঘোষালের কথায়, “ইউরোপের নানা দেশে এক জন ডাক্তার কোনও ভাবেই দিনে তিনটের বেশি পোস্ট মর্টেম করেন না। এখানে তেমন নিয়ম নেই। থাকলেও মানা সম্ভব নয়। পরিকাঠামোর দিকে সরকার দৃষ্টি দিলে কাজের গতি বাড়বে।”
সুতরাং মেডিক্যাল অফিসারদের তালিম দিয়ে ময়না-তদন্তের কাজে লাগালে সাধারণ মানুষেরই সুবিধা হবে বলে মনে করছে পুলিশ-ফরেন্সিকের একাংশ। এসএসকেএমের ফরেন্সিক মেডিসিনের প্রধান বিশ্বনাথ কাহালি বলেন, “দেশের আইন অনুযায়ী, মেডিক্যাল কলেজগুলোয় এমডি চিকিৎসকেরা ও জেলা হাসপাতালে অ্যালোপ্যাথির যে কোনও মেডিক্যাল অফিসার ময়না-তদন্ত করতে পারেন। কিন্তু অনেকেই করতে চান না। প্রথাগত প্রশিক্ষণ না-থাকা যার বড় কারণ।”
তাই তেমন প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত হলে লাভ বই ক্ষতি নেই বলে ওঁরা মনে করছেন। তবে উল্টো মতও রয়েছে। কী রকম? কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের এক শিক্ষকের সংশয়, “জেলায় যে সব মেডিক্যল অফিসার এখন পিএম করেন, তাঁদের অধিকাংশ অবসরের মুখে। এই বয়সে নতুন করে কিছু শেখার আগ্রহ ক’জনের থাকবে?” পাশাপাশি অন্য বিপদের আশঙ্কাও শোনা যাচ্ছে চিকিৎসকদের একাংশের মুখে। যেমন একটি জেলার মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের এক অধ্যাপকের মন্তব্য, “অনভিজ্ঞ ডাক্তারকে সাকুল্যে ছ’মাস শিখিয়ে-পড়িয়ে পিএম করতে দিলে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এতে বহু মৃতের পরিবার সমস্যায় পড়তে পারেন।”
অর্থাৎ নয়া ব্যবস্থায় জটিলতা বাড়বে বই কমবে না বলে ওঁদের আশঙ্কা। বাস্তবে কী হবে, সময়ই বলবে। |