প্রতি বছরই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে কয়েক মাসের জন্য বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে ফেরে গোপীনাথ বিগ্রহ। কিন্তু এ বার অগ্রদ্বীপের মানুষ গোঁ ধরেছেন, গোপীনাথকে তাঁরা নদিয়ার ওই রাজবাড়িতে যেতে দেবেন না।
এর একটা কারণ যদি ‘ভূমিপুত্র’ গোপীনাথকে ঘিরে আবেগ হয়, অপরটা অবশ্যই আর্থিক। অগ্রদ্বীপের বাসিন্দাদের বড় অংশের অভিযোগ, গোপীনাথ মন্দিরের প্রণামী ও তাকে ঘিরে মেলা বাবদ যে মোটা টাকা আয় হয়, তার বেশির ভাগটাই পুরোহিত মারফত রাজপরিবারের হাতে চলে যায়। এলাকা উন্নয়নের কাজ তো নয়ই, এমনকী জীর্ণ মন্দির সংস্কারের কাজটুকুও হয় না।
গোপীনাথ কৃষ্ণনগরের রাজাদের গৃহদেবতা। ওই বিগ্রহ ঘিরেই রাজবাড়ি প্রাঙ্গণের বিখ্যাত বারদোলের মেলা এবং রথ। নাকাশিপাড়ার বারগোড়ার মেলায় ছ’দিন থাকে বিগ্রহ। অগ্রদ্বীপ থেকে কৃষ্ণনগরে ফেরার পথে নবদ্বীপ মন্দিরেও থাকে কয়েক দিন।
কাজেই গোপীনাথ উদ্ধারে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরসূরিরা। পুলিশকে লিখিত ভাবে সব জানানো হয়েছে। রাজপরিবারের সদস্য মণীশচন্দ্র রায় অগ্রদ্বীপে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। ঘুরে গিয়েছেন কাটোয়া মহকুমা পুলিশের কর্তারা। কিন্তু বরফ গলেনি। বরং গত রবিবার অগ্রদ্বীপ, কাটোয়া, দাঁইহাট, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এমনকী পুরী-গয়া থেকে আসা ভক্তেরাও সভা করে ঠিক করেছেন, ওই বিগ্রহ আর রাজবাড়িতে পাঠানো হবে না। |
অগ্রদ্বীপ মন্দিরে গোপীনাথ।—নিজস্ব চিত্র। |
গোপীনাথের উপরে অগ্রদ্বীপের দাবির প্রাথমিক কারণটি ঐতিহাসিক। কথিত আছে, শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষই অগ্রদ্বীপ গ্রামে গোপীনাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করান। স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে গোপীনাথেরই প্রতি ছিল তাঁর স্নেহ। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে যেন গোপীনাথই তাঁর পিণ্ড দেয়। সে ব্যবস্থাই হয়েছিল। সেই থেকে আজও প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশীতে গোপীনাথকে কাছা পরিয়ে পিণ্ড দিতে মন্দির থেকে বের করা হয়। আর সেই দিন থেকেই অগ্রদ্বীপে শুরু হয় গোপীনাথের মেলা, যার আর এক নাম গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের শ্রাদ্ধ মেলা।
বিগ্রহটি কী করে অগ্রদ্বীপ থেকে কৃষ্ণনগর পৌঁছেছিল, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। রাজপরিবারের বধূ অমৃতা রায়ের মতে, “মৃত্যুর আগে ঘোষ ঠাকুরই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাবা রঘুরামকে বিগ্রহটিকে দিয়ে যান। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ীই অগ্রদ্বীপে গিয়ে পিণ্ডদান করেছিলেন গোপীনাথ। ওই সময় থেকে বছরের প্রায় পাঁচ মাস অগ্রদ্বীপেই থাকে বিগ্রহ। তার জন্য রাজপরিবার ওখানে একটি মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করে।”
কাটোয়ার ইতিহাস গবেষক কালীচরণ দাস অবশ্য দাবি করেন, “১১৭০ বঙ্গাব্দে মাতৃবিয়োগের পরে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্থানীয় জমিদারের কাছ থেকে মূর্তিটি নিয়ে গিয়েছিলেন। দু’বছর পরে বিগ্রহ অগ্রদ্বীপে ফেরে। পরে গোপীনাথের উৎসবের সময়ে বেশ কয়েক জন মারা যান। মুর্শিদকুলি খাঁ তার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরের রাজা তখন হস্তক্ষেপ করেন। সেই থেকেই গোপীনাথ বিগ্রহ কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যাতায়াত করছে।”
বেশ ক’বছর আগেও এক বার গ্রামবাসীরা বিগ্রহ রাজবাড়িতে যেতে দেবেন না বলে দাবি করেন। তা জেনে রাজবাড়িও আর মূর্তি ছাড়তে চায়নি। তখন মন্দিরের পুরোহিত দিলীপ মুখোপাধ্যায় ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে সই করে বিগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন। সেই নিয়মই চলছে। তবে পুরোহিতের বদলে এ বার নবান্ন উৎসবে গ্রামের চার প্রবীণ বাসিন্দা সই-সাবুদ করে মূর্তিটি এনেছেন।
অগ্রদ্বীপবাসীর অভিযোগ, একটা সময়ে রথযাত্রার পরেই বিগ্রহ আসত। ফিরত চৈত্র মাসে গোপীনাথ মেলার সপ্তাহখানেক পরে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে রাজপরিবার তাদের খেয়ালখুশি মতো বিগ্রহ পাঠাচ্ছে। কখনও দুর্গাপুজোর সময়ে, কখনও নবান্ন উৎসবের সময়ে। স্থানীয় ষষ্ঠী ঘোষ, রাজকুমার ঘোষদের কথায়, “বছরে ছ’মাস মন্দির ফাঁকা থাকে। দর্শনার্থীরা শূন্য মন্দির দেখে ফিরে যান। দূর থেকে এসেও কেউ প্রসাদ পান না। আর গোপীনাথ রাজবাড়িতে বন্দি থাকেন!”
অমৃতাদেবীর পাল্টা বক্তব্য, “বছরে পাঁচ মাসই তো অগ্রদ্বীপে বিগ্রহ থাকে। আর আমরা মোটেই গোপীনাথকে বন্দি করে রাখি না। বারদোল বা মেলায় সাধারণের দর্শনের জন্য তাঁকে বের করা হয়। তা ছাড়া, গৃহদেবতাকে কে কবে বাইরে বের করে রাখেন? আমরা তো ব্যবসা করব বলে তাঁকে প্রণামীর বাক্স হাতে ধরিয়ে রাস্তায় নামাতে পারি না!”
গ্রামবাসীদের আবার অভিযোগ, দর্শনার্থীরা যে প্রণামী বা দানসামগ্রী দেন, তাতে পুরোহিত বা রাজবংশের লাভ হয়। মন্দির বা এলাকার কোনও উন্নয়ন হয় না। এক মাত্র স্থানীয় পঞ্চায়েত ও মেলা কমিটি মেলার যে অংশ পরিচালনা করে, তা থেকে আয় উন্নয়নের কাজে লাগে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বর্তমান বংশধর সৌমীশচন্দ্র রায় অবশ্য দাবি করেন, “গোপীনাথের পুরোহিত সব মিলিয়ে বছরে আমাদের এগারো হাজার টাকা ‘দ্বারপ্রাপ্তি’ হিসেবে দেন। এর বাইরে মন্দির বা মেলা থেকে আয়ের কোনও টাকা আমরা পাই না বা নিই না। মেলা ও মন্দিরের আয় যাঁরা ভোগ করেন, তাঁদেরই উচিত মন্দির ও এলাকার উন্নয়নের কাজে তা খরচ করা।”
পুরোহিত দিলীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ছ’পুরুষ ধরে রাজপরিবার দ্বারা গোপীনাথের সেবায় নিযুক্ত। কিন্তু রাজপরিবারের সঙ্গে আমার চুক্তিতে উন্নয়ন করার কথা নেই। কোনও ভক্ত উন্নয়ন করতে চাইলে রাজপরিবারের অনুমতি নিয়ে তা করতে পারেন।” পুরোহিতের দাবি, প্রণামী-দান-মেলা থেকে বছরে বড়জোর দেড় লক্ষ টাকা আয় হয়। যদিও গ্রামবাসীদের মতে, অঙ্কটা কমপক্ষে সাত থেকে আট লক্ষ।
অগ্রদ্বীপের বিগ্রহ রাখার চেষ্টার পুরোভাগে রয়েছেন বর্তমানে কাটোয়া শহরের টেলিফোন ময়দানের বাসিন্দা জহর দে। তিনি জানান, ২৩ জনের ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হচ্ছে। তার আগে মন্দিরের উন্নয়ন ও নিত্যভোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিগ্রহ আর কৃষ্ণনগরে ফেরানো হবে না। পুরোহিত বলেন, “কয়েক দিন আগে গ্রামবাসীরা আমায় বলেন, ‘আপনাকে মোটা বেতন দেব। কিন্তু আপনি আর প্রণামীর টাকা বা কোনও দানসামগ্রী নিতে পারবেন না।’ আমি ওঁদের কথা মেনে নিয়েছি।”
কৃষ্ণনগর আর গোপীনাথকে ফিরে পাবে কি না, তাতেই বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গিয়েছে। |