সংরক্ষিত মন্দিরের রূপবদল সংস্কারে
কটি প্রাচীন জৈন মন্দির সংস্কার করতে গিয়ে তার রূপ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে সামান্য দূরে দ্বারকেশ্বর নদের উত্তর পাড়ে ধরাপাট গ্রামের এই মন্দিরটি পাথর দিয়ে তৈরি। তার উপরে চুন-সুরকির পলেস্তারা দেওয়া ছিল। মন্দিরের নীচের অংশের রং ছিল সাদা। উপরের অংশটি ছিল কালো। সংস্কারের পরে পুরো মন্দিরটিই ঝকঝকে গেরুয়া রঙের হয়ে গিয়েছে। সংস্কারের সময়ে মন্দিরগাত্রের অলঙ্করণেও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের উপরে একটি অলঙ্করণের নকশা সংস্কারের পরে বদলে গিয়েছে বলে দাবি স্থানীয় ইতিহাসবিদদের।
মন্দিরটি রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের সংরক্ষিত। সংস্কারের কাজ করেছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শিল্পী শুভাপ্রসন্ন বলেন, “মন্দির সংস্কারের কাজ অনেক জায়গাতেই হচ্ছে। বিজ্ঞানসম্মতভাবেই সে কাজ করা হচ্ছে। এই মন্দিরটি সংস্কারের কাজও করেছেন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই। রং পরিবর্তিত হওয়ার কথা নয়। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।” হেরিটেজ কমিশনের প্রকল্প কমিটির চেয়ারম্যান পার্থরঞ্জন দাসও বলেন, “পাথরের মন্দিরের উপরে কখনওই রং করা উচিত নয়। ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে তৈরি এই মন্দিরটি। সে কারণেই তার উপরে চুন-সুরকির পলেস্তারা দেওয়া হয়েছিল। সংস্কারের ক্ষেত্রেই সেই একই নিয়ম মেনে চলা উচিত ছিল।” তাঁর বক্তব্য, “আমি ওই মন্দিরটি নিজে গিয়ে পরিদর্শন করব এবং জানতে চেষ্টা করব, এ ধরনের কাজ কী করে হল?” রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ-অধিকর্তা অমল রায়ও বলেন, “যৌথভাবেই ওই মন্দিরটি পরিদর্শন করা যায়। সংস্কারের সময়ে কোনও বিকৃতি ঘটলে, তা পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।”
জৈন মন্দিরের দুই রূপ। সংস্কারের আগে (বাঁ দিকে) ও পরে। ছবি: শুভ্র মিত্র।
ইতিহাসবিদদের অনুমান, মন্দিরটি বেশ প্রাচীন। বাংলায় জৈন ধর্ম খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। হিউয়েন সাং বা জুয়ানজাং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত ও জৈন ধর্মগ্রন্থ জৈনকল্পসূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, তারপরেও প্রাচীন বাংলার বিরাট অংশে জৈন প্রভাব ছিল। তবে গুপ্তযুগ থেকে প্রভাব কমতে থাকে। খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতক নাগাদ জৈন ধর্মের প্রভাব একমাত্র রাঢ় ভূখণ্ডেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাঁকুড়ায় ধরাপাট ছাড়াও বহুলাড়ায় এই ধরনের মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরটি দশম শতকে তৈরি বলে অনুমান। সেখানে পার্শ্বনাথের মূর্তি রয়েছে। জৈন স্তূপও রয়েছে। তাই সেটিও জৈন মন্দিরই ছিল বলে মনে করেন পুরাতত্ত্ববিদেরা। ইতিহাসবিদদের অনুমান, ধরাপাটের মন্দিরটিও বহুলাড়ার সমসাময়িক। কেননা স্থাপত্যরীতি ও মূর্তিগুলি প্রায় এক রকম।
মল্ল রাজা বীর হাম্বীর ১৬০৩ সালে মন্দিরটির সংস্কার করেছিলেন। হাম্বীর ছিলেন শৈব। মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। আকবরের সেনাপতি রাজা মান সিংহর ছেলে রাজা জগৎ সিংহকে তিনি সাহায্য করেছিলেন বলে আবুল ফজলের লেখা থেকে জানা যায়। ইতিহাসবিদদের অনুমান, ১৫৬৫ থেকে ১৬২০ সাল পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। তাই তিনি ধরাপাটের মন্দিরের গায়ে পুব দিকে একটি তিন ফুটের বাসুদেব মূর্তিও স্থাপন করেন বলে অনুমান করা হয়। মন্দিরটির পশ্চিম দিকে রয়েছে পার্শ্বনাথের মূর্তি। উত্তর দিকে রয়েছে আদিনাথ। আদিনাথের মূর্তিটি পাঁচ ফুটের। বিষ্ণুপুর আচার্য যোগেশচন্দ্র সংগ্রহশালার সচিব চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “ধরাপাট ছিল প্রাচীন জৈন কেন্দ্র। মন্দিরটিও জৈন মন্দির।”
মন্দিরের গায়ে গাছপালা জন্মে গিয়েছিল। তার শিকড় মন্দিরে ফাটল ধরিয়ে দিতে পারত। শ্যাওলাও তৈরি হয়েছিল। সে সব অবশ্য সংস্কারের সময় পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে চিত্তরঞ্জনবাবুর দাবি, “সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংস্কার করতে গিয়ে যে ভাবে মন্দিরটির বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, তা লজ্জাজনক। মন্দিরের অলঙ্করণেও বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।” গ্রামবাসীদের একাংশেরও বক্তব্য, সংস্কারের পরে মন্দিরে প্রাচীনত্বের ছোঁয়াটুকু যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এই ধরনের প্রাচীন মন্দির সংস্কারের পদ্ধতি কী? মন্দির সংস্কারে বিশেষজ্ঞ পার্থরঞ্জনবাবু জানান, পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রথমে দেখা দরকার পুরনো মন্দিরটির কাঠামো ঠিক কী ছিল। তারপরে সেটা সেই ভাবেই ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, “চুন-সুরকির পলেস্তারা থাকলে, সেই পলেস্তারাই দিতে হবে। সিমেন্ট ব্যবহার করা যাবে না।”
আচার্য যোগেশচন্দ্র সংগ্রহশালার কিউরেটর তুষার সরকারের দাবি, “মন্দিরটি সংস্কারের আগে কোনও গবেষণাই করা হয়নি। সে কারণেই এই বিকৃতি ঘটেছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.