রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
বঙ্গ ক্রিকেটে তিনি অতীত। দীর্ঘ দিন উপেক্ষিত হয়ে বাংলা ছেড়েছেন, যোগ দিয়েছেন রেলওয়েজে। কিন্তু অদৃষ্ট এমনই, অতীতের ‘উপেক্ষিত’ বঙ্গসন্তান আজ বাংলা ক্রিকেটের এক নম্বর কাঁটা!
অরিন্দম ঘোষ এখন লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র বাংলার রঞ্জি ট্রফির শেষ চারে যাওয়ার হাইওয়েতে প্রধান ‘প্রাচীর’ হিসেবে আবির্ভূত। ইডেনে বুধবার থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলার বিরুদ্ধে রেলের হয়ে নামবেন যে!
অতীতের দিনগুলো মনে পড়লে অরিন্দম ঘোষের এখনও খারাপ লাগে। বাংলায় ছ’বছর ছিলেন রেলে চলে যাওয়ার আগে। ওই ছ’বছরে বাংলার হয়ে খেলেছেন সাকুল্যে ছ’টা ম্যাচ। অথচ চলতি মরসুমেই রেলের হয়ে আটটা ম্যাচই খেলছেন, ডাবল সেঞ্চুরি আছে, আছে ছ’শো রান এবং অরিন্দম ঘোষ ইডেনে ঢুকছেন উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে ১৮১ রানের ইনিংস খেলে!
যে ফর্ম দেখে আফসোস করছে বঙ্গ ক্রিকেটমহল। সিএবি-র একটা অংশ থেকে বলাবলি চলছে , অরিন্দম বাংলা ছেড়ে যাননি। বরং বাংলা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ময়দানের অভিযোগ— মনোজ তিওয়ারির বাংলা তাঁকে ‘ইচ্ছাকৃত’ তিন নম্বরে পাঠাত। যেখানে তিনি পাঁচ কিংবা ছ’নম্বর পজিশনের স্বাভাবিক ব্যাটসম্যান। তত্কালীন বাংলা নির্বাচক কমিটি তাঁকে নিয়ে ‘সি-স’ খেলত।
ময়দানের অভিযোগ— হাফসেঞ্চুরি করেও তাঁকে পরের ম্যাচে বাদ পড়তে হয়েছিল। টিমে তিনি ছিলেন প্রায় বরাবরের দ্বাদশ ব্যক্তি। অথচ ভাল ব্যাটসম্যান, দুর্ধর্ষ ফিল্ডার। তবু জল বওয়াটাই ছিল মুখ্য কাজ।
বৃহস্পতিবার সন্ধেয় যে কথা শুনে অরিন্দম তাঁর প্রাক্তন সতীর্থ বা টিম ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাইলেন না।
মনোজ আবার অভিযোগনামা শুনে প্রায় ফেটে পড়লেন। |
“কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে তিন নম্বরে
পাঠাত,
এটা ভুল... কিন্তু কিছু অবিচারও হয়েছে।
মনে আছে
একটা ম্যাচে, বাংলার অনেক ক্রিকেটার
অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দেখলাম, অনূর্ধ্ব ২২
থেকে অনেক ছেলে ফার্স্ট ইলেভেনে ঢুকে গেল।
কিন্তু আমি স্কোয়াডে থেকেও মাঠে নামলাম না।”
|
অরিন্দম ঘোষ
|
মনোজ তিওয়ারি |
“আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে, আমার
ক্যাপ্টেন্সির সময় সবাইকে যথেষ্ট সুযোগ
দেওয়া হয়েছিল। অরিন্দমও পেয়েছিল। কিন্তু
সুযোগটা তো কাজেও লাগাতে হবে...আমি কি একা
টিম করতাম? আর যাঁরা এখন হা-হুতাশ করছেন
ওর চলে যাওয়া নিয়ে, তাঁদের তখন উচিত ছিল
ওকে আটকানো। বিকল্প চাকরি দেওয়া!”
|
|
দিল্লি থেকে ফোনে অরিন্দম বলছিলেন, “কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে তিন নম্বরে পাঠাত, এটা ভুল। টিমের প্রয়োজনে আমাকে যেতে হত। তবে কিছু অবিচারও হয়েছে আমার সঙ্গে। মনে আছে, একটা ম্যাচে বাংলার অনেক ক্রিকেটার অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার পরেও দেখলাম, অনূর্ধ্ব-২২ থেকে অনেক ছেলে ফার্স্ট ইলেভেনে ঢুকে গেল। কিন্তু আমি স্কোয়াডে থেকেও মাঠে নামলাম না।” সঙ্গে সংযোজন, “আবেগ বাদ রেখেই বলছি, কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলা ম্যাচটার জন্য আলাদা খাটব আমি। এটা আমার কাছে প্রেস্টিজ ইস্যু। সত্যি বলতে, বাংলার হয়ে খেলার মর্যাদাটা আমি রেল থেকে পাই না। কিন্তু রেলে খোলা মনে ব্যাট করতে পারি। বাংলায় বেশি সুযোগ পেতাম না। বলা হত, একটা কী দু’টো ম্যাচ পাব। আপনি-ই বলুন, একটা বা দু’টো ইনিংসে তো ব্যর্থও হতে পারি!”
যা শুনে, অভিযোগের মেঘ প্রধানত তাঁর উপর ঘনীভূত হচ্ছে দেখে পাল্টা দিচ্ছেন মনোজ তিওয়ারি। প্রাক্তন বঙ্গ অধিনায়ক স্পর্ধিত ভঙ্গিমায় শুনিয়ে রাখলেন, “দেখছি, অনেকের মধ্যে একটা কমপ্লেনের স্বভাব চলে আসছে। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে, আমার ক্যাপ্টেন্সির সময় সবাইকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অরিন্দম রেলের হয়ে ভাল খেলছে, তাতে আমি খুশি। কিন্তু এখানেও ও যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সুযোগটা তো কাজেও লাগাতে হবে! রান না করতে পেরে অনুষ্টুপের মতো ক্রিকেটারকেও কিন্তু বাদ পড়তে হয়েছে।”
মনোজ আরও যোগ করছেন, “এখন বলা হচ্ছে তিন নম্বরে কেন ওকে পাঠানো হত? বাংলার তখনকার ব্যাটিং লাইন আপটা দেখে নিন। চারে আমি ছিলাম। পাঁচে ঋদ্ধি, ছ’নম্বরে অনুষ্টুপ, সাতে লক্ষ্মী। কোথায় পাঠাতাম ওকে? রেলে এখন রান করছে ঠিক আছে। তবে দেখতে হবে কোন পরিস্থিতিতে রান করছে? কতগুলো বল নিচ্ছে? আর রেলের ব্যাটিং লাইন আপে তারকা কোথায়? আমার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। আমি কি একা টিম করতাম? যাঁরা এখন হা-হুতাশ করছেন ওর চলে যাওয়া নিয়ে, তাঁদের তা হলে তখন উচিত ছিল ওকে আটকানো। বিকল্প চাকরি দেওয়া!”
কে ঠিক, কে ভুল—তর্কের চেয়েও অবশ্য প্রাসঙ্গিক হল, বাংলা যেমন এক প্রতিভাবান তরুণকে হারিয়েছে, তেমনই আবার দু’জনকে পেয়েওছে। বঙ্গ ক্রিকেটমহলের মনে হচ্ছে, যে দু’জনের ক্ষেত্রে কোনও রকম ভুল না করে সিএবি-র উচিত দুই-কে ‘সংরক্ষণ’ করা।
প্রথম জন— সুদীপ চট্টোপাধ্যায়।
দ্বিতীয় জন—ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়।
কেউ কেউ বলছেন, লক্ষ্মীরতন শুক্লকে অধিনায়ক করার ব্যাপারে বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট চিত্রক মিত্র উদ্যোগী না হলে টিমে এতগুলো জুনিয়র খেলতে পারত কি না সন্দেহ। তামিলনাড়ু ম্যাচে ঋত্বিককে বল দেওয়ার সময় তাঁকে অধিনায়কের বলা, ‘যাও চ্যাম্পিয়ন, জীবনের বলটা করে এসো’ নিয়ে এ দিনও সপ্রশংস আলোচনা চলল বাংলা ক্রিকেটমহলে। টিমের সিনিয়রদের কেউ কেউ বলছেন, দু’বছর আগের গুমোট পরিবারটা আর নেই। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী যথেষ্ট ভরসা রাখেন সুদীপ-ঋত্বিকের মতো জুনিয়দের উপর। বলেও দেন, “ওদের বুকের খাঁচা বড়। অনেক দূর যাবে।”
ঋত্বিক-সুদীপরা কত দূর যাবেন, সময় বলবে। কিন্তু তাঁদের উত্থানের প্রেক্ষাপট যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। নানাবিধ বৈরিতার বিরুদ্ধে লড়ে ওঠা। একই অ্যাকাডেমি (সৃষ্টি), প্রায় প্রতিবেশী দুইয়ের মধ্যে ঋত্বিককে যেমন লড়তে হয়েছে মাঠের রাজনীতির সঙ্গে। সুদীপকে তেমন আবার লড়তে হয়েছে মাঠের বাইরের এক ‘শত্রু’-র সঙ্গে। দারিদ্র্য।
কেউ জানে, যে ঋত্বিকের বোলিং নিয়ে আজ এত হইচই, অনূর্ধ্ব-১৯ এক বাংলা কোচ তাঁর বোলিংটাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন? রাজ্য ম্যাচে আম্পায়ারকে ডেকে সেই কোচ বলেছিলেন, দেখবেন ছেলেটাকে, চাক করে! কেন? কারণ ঋত্বিক সেই কোচের ইচ্ছেমতো স্পোর্টিং ইউনিয়ন যেতে চাননি!
কেউ জানে, ক্লাব ক্রিকেট খেলে বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল সুদীপকে? পড়াশোনা বন্ধ হয়েছিল অর্থাভাবে। মাঠেও যথেষ্ট ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে হয়েছে সুদীপকে। আগে নেমেই যথেচ্ছ শট খেলার প্রবণতা ছিল। কিন্তু চলতি রঞ্জির আগে অফ সিজনে সেই প্রবণতা ছেঁটে ফেলার প্র্যাকটিস করেছেন। তবেই এসেছে গ্রিনটপে উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে ৬৬। তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর টার্নারে দু’ইনিংসেই চল্লিশের কাছাকাছি। সঙ্গে যোগ করতে হবে টুর্নামেন্টে দুর্ধর্ষ ফিল্ডিংয়ে কিছু অবিশ্বাস্য ক্যাচ। এমন কাঠিন্য কোথা থেকে এল? সুদীপ বললেন, “ছোটবেলা থেকে যুদ্ধ করছি। মানসিকতাটা ওখানে তৈরি হয়ে গিয়েছে। আর সৌরভ গাঙ্গুলির থেকে অনেক শিখেছি।” আর ঋত্বিক? তাঁর ছোটবেলার কোচ প্রসেনজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “অজয় বর্মা ওর বিরুদ্ধে ইচ্ছে করে চাকিংয়ের অভিযোগ এনেছিল। পারল আটকাতে?”
ঘটনা। ঋত্বিকের বল বাংলাকে জিতিয়েছে, তামিলনাড়ুর শেষ উইকেট তুলে কোয়ার্টারে তুলেছে, এবং আজ সগর্বে তিনি বলেও দিতে পারছেন, “জীবনের সেরা বল।” |