প্রবন্ধ...
সেই হলিউডের কলে পড়ে গেলাম না তো
উটিউবে একটু খুঁজলেই আড়াই মিনিটের একটি ভিডিয়ো চোখে পড়ে। মামাহোপ নামে এক সংস্থার তৈরি। ভিডিয়োটির নাম ‘আফ্রিকান মেন, হলিউড স্টিরিয়োটাইপস’। হলিউডের বিভিন্ন ছবিতে আফ্রিকান চরিত্রদের অহরহ যে ভাবে দেখানো হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
‘চাঁদের পাহাড়’ দেখতে গিয়ে ওই ভিডিয়োটার কথা নতুন করে মনে পড়ল। ১৯৩৭ সালে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর প্রস্তাবনায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘চাঁদের পাহাড় কোনও ইংরিজি উপন্যাসের অনুবাদ নয় বা ঐ শ্রেণীর কোনও বিদেশী গল্পের ছায়াবলম্বনে লিখিত নয়।... তবে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক সংস্থান ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনাকে প্রকৃত অবস্থার অনুযায়ী করবার জন্য আমি স্যার এইচ এইচ জনস্টন, রোসিটা ফরব্স্ প্রভৃতি কয়েকজন বিখ্যাত ভ্রমণকারীর গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করেছি।’
বিদেশি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো উপন্যাস বাংলায় মৌলিক ভাবে লেখা সম্ভব, এটা প্রমাণ করার একটা তাগিদ বিভূতিভূষণের ছিল। অনুমান করা কঠিন নয়, সেই যুগে এর মধ্যে এক ধরনের জাতীয়তাবাদী চ্যালেঞ্জও নিহিত ছিল। এক দিকে লেখক হিসেবে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর মতো একটা কাহিনি বাংলায় বসে লিখে দেখানো। অন্য দিকে শঙ্করের মধ্যে দিয়ে ‘মাথায় ছোট বহরে বড়’ বাঙালি সন্তানের প্রতিস্পর্ধী একটা অবয়ব তৈরি করা। এই উপন্যাস জুড়ে শঙ্কর সর্বদা মনে রাখে যে, সে ইস্ট ইন্ডিজ তথা ভারতের প্রতিনিধি।
বিধিলিপিই বলা উচিত কি না কে জানে! ২০১৩’য় এসে যখন ‘চাঁদের পাহাড়’ ছবি হল, কালের গতিমুখ তাকেও একটা স্পর্ধিত স্বর হিসেবেই উপস্থিত করল। দেখো হে, টালিগঞ্জও পারে— এই কথাটা চোঙা ফুঁকে বলার দায় তার ঘাড়ে এসে পড়ল। তাতে আপত্তির কিছু নেই। ছবির ভাল-মন্দ বিচারেও যাচ্ছি না। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর কাহিনিচিত্র আফ্রিকান সাফারি বা অ্যানিমাল প্ল্যানেটের বঙ্গ সংস্করণে পর্যবসিত হওয়া উচিত কি না, সে তর্কেও না। কিন্তু এ সব কিছু বাদ দিয়েও দু’একটি অশনি সংকেত রয়ে যাচ্ছে, যা অবজ্ঞা করার নয়।
বিভূতিভূষণকে আফ্রিকার বর্ণনা খোঁজার জন্য সাহেবদের লেখার ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। অন্যতর উপাদান তাঁর কাছে ছিল না। পরিণামে প্রায় অজান্তেই তাঁর লেখায় যে আফ্রিকার নির্মাণ ঘটে, তা সাহেবদের চোখ দিয়ে দেখা ‘আফ্রিকা’। সেখানে প্রতি পদে হিংস্র শ্বাপদ আর জংলী উপজাতির আনাগোনা। ‘আরণ্যকে’ দেহাতি জনজীবনের যে আশ্চর্য মরমি আখ্যান গড়ে ওঠে, আফ্রিকার জনজাতিদের জন্য সেই সুরটি অশ্রুত থেকে যায়। এর আগে একই কাণ্ড ঘটেছিল হেমেন্দ্রকুমারের ‘আবার যখের ধন’-এও। বাংলা সাহিত্য পাশ্চাত্যের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে পাশ্চাত্যবাদের একটা অন্য কলের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল।
কিন্তু লেখার এই খামতিটুকু ২০১৩-র ছবিতে মেরামত করে নেওয়া গেল না? না কি বিভূতিভূষণের মতোই হলিউডের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে হলিউডি কলে পড়ে গেলাম! হাতি-প্যাঁচা-সিংহ-চিতা আর কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতি সব এক একটা আইটেম হয়ে উঠল। বন্যেরা বনে সুন্দর-এর প্রদর্শশালা। বিগ বাজেট বাংলা ছবি যখন আজ মিশর কাল দক্ষিণ আফ্রিকা দৌড়চ্ছে, তখন হলিউডের কু-প্রবণতাগুলো যেন আমাদের উপরে না বর্তায়, সেটা খেয়াল রাখা দরকার বইকী! লেখায় যাও বা আবডাল থাকে, ভাষায় যা কিছু অমূর্ত থাকে, পর্দায় তা থাকে না। সুতরাং সাবধানতা সেখানে আরও বেশি জরুরি। হলিউড থেকে চিত্রনাট্যের বুনোট শেখা হোক, কারিগরি কৃত্‌কৌশল শেখা হোক, অভিনয় শেখা হোক— ভিনগোত্রীয় মানুষকে ঢালাই ছাঁচে ফেলে দেওয়া, মানুষকে অবজেক্টে পরিণত করার বিপজ্জনক বদভ্যাস যেন ঘাড়ে চেপে না বসে। যে কোনও শিল্পকেই শিল্প হয়ে উঠতে গেলে সমকালীন হতে হয়। এটা সেই সমকালীনতার দাবি। পিরিয়ড পিসের মেজাজ অক্ষুণ্ণ রাখার সঙ্গে এর কোনও দ্বন্দ্ব নেই।
কাজটা কঠিনও নয়। তার সবচেয়ে বড় কারণ, এটা বিভূতিভূষণের আমল নয়। পাশ্চাত্যবাদের রাজনীতি এখন কারও অগোচর নেই। আর শুধু পশ্চিমী আকরের উপরে নির্ভর করার বাধ্যবাধকতাও নেই। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, টলি বা বলি-র মূলধারায় নিজের দেশের প্রান্তিক জনজীবনকেই বা কবে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে দেখানো হয়েছে যে আজ তার আফ্রিকার জন্য প্রাণ কাঁদবে? সংগত প্রশ্ন। কিন্তু মনন আর মেধার তকমা নিয়ে বাংলা ছবির নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান সে সব ছবির সঙ্গে জুড়ে থাকে না। তাদের প্রসঙ্গ এনে ‘চাঁদের পাহাড়’ নামটাকে লঘু করে না তোলাই সমীচীন। আর ঠিক এই কারণেই, ছবিটা ‘চাঁদের পাহাড়’ বলেই আরও একটা মারাত্মক অস্বস্তি কুরে খেতে থাকে। সেটা শঙ্করকে নিয়ে।
আফ্রিকার ছবি আঁকতে গিয়ে বিভূতিভূষণকে সাহেবি কেতাবের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। কিন্তু শঙ্কর তাঁর একান্ত নিজের। সেখানে ‘আরণ্যক’ বা অপু-চরিতের সঙ্গে তার কোনও দূরত্ব নেই। অপু, সত্যচরণ, শঙ্কর— একই রকম প্রকৃতি-মোহিত, রোম্যান্টিক। বিভূতিভূষণ এ কথা আলাদা করে বলা দরকার মনে করেছেন যে, শঙ্করের চরিত্রে ‘সৌন্দর্যপ্রিয়, ভাবুক’ মনটিই আসল কথা। ‘হাজার হোক সে বাঙলার মাটির ছেলে, ডিয়েগো আলভারেজের মতো শুধু কঠিন প্রাণ স্বর্ণান্বেষী প্রসপেক্টর নয়।’ ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস যে কালজয়ী হয়েছে, তা শুধুমাত্র ‘বাংলা উপন্যাসে আফ্রিকার জঙ্গল’ বলে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে নয়। অসামান্য ভাষা আর শঙ্করের মতো চরিত্রের জন্যই। ছবিতে তার কতটা প্রতিফলন আছে, সে আলোচনার পরিসর ভিন্ন। কিন্তু শঙ্করকে দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে সিংহ আর বুনিপ শিকার করিয়ে এ ছবি কী বার্তা দিল, সেই প্রশ্নটা তোলা আশু প্রয়োজন। এমন রক্তস্নাত প্রতিশোধস্পৃহা বিভূতিভূষণের মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় কি না, সে তর্ক বাদই দিলাম। প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে বিশ্বজোড়া এই সঙ্কটের মুহূর্তে কোন সমকালীনতার দায় মেনে ছবিতে এমন দৃশ্য রাখা হবে, সাধারণ ভাবেই এই প্রশ্নটা করা উচিত। তার উত্তর কি বক্স অফিস-এর অমোঘ আকর্ষণ? গল্পে নায়িকা নেই, ভিলেন নেই। নায়ককে ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা’ গোছের কিছু মুহূর্ত তো দিতে হবে! অতএব সিংহ আর বুনিপকে খতম করে ফেলো! আত্মরক্ষার দায়ে নয়, স্রেফ খুন কা বদলা খুনের নীতিতে। প্রতিহিংসার উত্‌সবে। যে লোক ময়ূরকে গুলি করতে যায়, সে দুষ্টু লোক (সোনার কেল্লা)— সংবেদনের এই উত্তরাধিকারকে তবে সগর্বে বিসর্জন দিতে শিখলাম আমরা। ‘মননশীল’ বাংলা ছবির অভিযাত্রা যদি এই পথই নেয়, তা হলে সেটা অত্যন্ত বেদনার।
১৯৫৯ সালের একটা ছবির কথা স্মরণ করব এই আবহে। মরুতীর্থ হিংলাজ। সেই ছবির পরিচালক বিকাশ রায় বালুচিস্তান দৌড়ে যেতে পারেননি ঠিকই। সাদা-কালো ছবি। অর্থের বৈভব, প্রযুক্তির চাকচিক্য কিছুই ছিল না। কিন্তু আজও দেখলে চোখের পাতা ভিজে আসে। বাংলা ছবি তার এত ঐশ্বর্যের দিনে ওই মানবিক আবেদনের জাদুটি কবে ফিরে পাবে, সেটাই ভাবনার। কত দূর আর কত দূর, বলো মা!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.