সৌর আশিসে আলোর রাস্তায়
চিপকে বাংলার লক্ষ্মীলাভ
ফোনের ও পার থেকে একের পর এক ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়ছেন লক্ষ্মীরতন শুক্ল। ‘খুনে’ ভঙ্গিতে বলে চলেছেন, “কী? কাল বলিনি, জিতব? অনেকে তো বলছিল, বাংলা নাকি বাইরে পারে না, ইডেনেই দৌড় শেষ। আজ জয়টা তাই ওদেরই উৎসর্গ করছি!”
বাংলা কোচের গলায় উত্তেজনা কম, ব্যঙ্গ বেশি। চেন্নাই থেকে ফোনে যে অশোক মলহোত্র-র গলা শোনা গেল, তাতে ডব্লিউ ভি রামনকে ‘কেমন দিলাম’ মেজাজটা অত্যন্ত প্রকট। “আরে, রামন তো আমাদের টিমকে টিম বলেই ধরেনি। ভেবে নিয়েছিল, বাংলার ব্যাটিং নেই। স্পিনার নেই। মেরে চলে যাবে। রামন তো সৌরাশিস লাহিড়ীকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল। আজ তো ও-ই রামনের টিমের বারোটা বাজিয়ে দিল।”
বারোটা বলাও বোধহয় ভুল। চিপকে ডব্লিউ ভি রামনের অর্ডারি ‘ধানখেতে’ বুধবার বঙ্গজ অফস্পিনার তামিলনাড়ুরই সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলেন।
৩৩-১০-৬২-৭! দীনেশ কার্তিক থেকে এস বদ্রীনাথ, তামিলনাড়ু ব্যাটিংয়ের মস্তিষ্ক থেকে বাকি শরীর কে রক্ষা পেল সৌরাশিসের স্পিনের বিষ থেকে?
যাঁরা ম্যাচটা দেখেননি, বাদই দেওয়া গেল। টিম বাংলার যাঁরা মাঠ থেকে সৌরাশিসের বিস্ফোরণ দেখলেন, তাঁরা সন্ধেতেও সৌরাশিসের বিস্ফোরণকে ব্যাখ্যা করার কোনও সঠিক বিশেষণ খুঁজে পাচ্ছেন না। শব্দকোষে টান পড়ছে। কারণ, বঙ্গ অফস্পিনারের ওই একটা কালজয়ী স্পেল হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে বাংলাকে। জিতিয়েছে চার রানে! জিতিয়েছে ১০২-১ থেকে ১৮০-তে তামিলনাড়ুর দ্বিতীয় ইনিংস শেষ করে, ৭৮ রানে রামনের টিমের ন-ন’টা উইকেট তুলে! কার্তিককে দু’বার, বদ্রীনাথকে একবার নিশ্চিত আউট না দেওয়ার পরেও। সৌরাশিসের ওই স্পেল যেমন বহু দিন পর কার্যত রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে দিয়েছে বাংলাকে, তেমন একই সঙ্গে প্রচুর অতৃপ্তির হিসেব মিটিয়েছে। সুদূর অতীতে বাংলার কোনও টিম চেন্নাইয়ে গিয়ে তামিলনাড়ুকে হারিয়ে আসতে পারেনি। আইপিএলে কেকেআরের পর্যন্ত বরাবর শক্ত গাঁট হয়ে থেকেছে চিপক। আইপিএল ফাইভ ফাইনালে চিপকে চেন্নাই সুপার কিংসকে হারানো ছাড়া কেকেআরেরও চেন্নাইয়ে মনে রাখার মতো বিশেষ কিছু নেই।
নায়ক সৌরাশিসকে ‘আদর’ বাংলা অধিনায়কের। বুধবার গভীর রাতে কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পর।
যেখানে সিএবি-র পক্ষ থেকে টিমকে স্বাগত জানানো হল ফুলের তোড়া ও কেক দিয়ে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
লক্ষ্মীরতন শুক্ল তাঁর নিজেরও কি শাপমুক্তি ঘটল না? পাঁচ বছর আগে এই চিপকে, এই ডব্লিউ ভি রামনের তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম ইনিংস লিড নিয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁকে ডুবে যেতে হয়েছিল। সে দিনও লক্ষ্মী ক্যাপ্টেন ছিলেন, আজও তাই। কিন্তু আজ রঞ্জি থেকে ছিটকে যাওয়া নয়। রামনের ডেরা থেকে কার্যত কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে তবেই মাঠ ছাড়ল লক্ষ্মীর বাংলা। গত দু’বছর ধরে বঙ্গ ক্রিকেটে ‘ব্রাত্য’ এক স্পিনারের মহানায়কীয় বোলিং পারফরম্যান্সে।
শোনা গেল, ম্যাচ শেষে ডব্লিউ ভি রামনের মুখচোখের দিকে নাকি তাকানো যাচ্ছিল না। উপস্থিত সাংবাদিকদের নাকি ক্ষুব্ধ রামন বলেও ফেলেছেন যে, ঠিকই হয়েছে। এটা যদি টার্নারে ব্যাটিংয়ের নমুনা হয়, তাঁর টিমের হারাই উচিত! প্রাক্তন বাংলা কোচের মেজাজ খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। একে তো ম্যাচের পরপরই বাংলা শিবির থেকে তাঁর দিকে ব্যঙ্গ ছোড়া হয়েছে। কেউ কেউ গিয়ে নাকি জিজ্ঞেসও করেছেন, এ রকম উইকেট বানিয়ে, আম্পায়ারদের উপর প্রভাব খাটিয়ে লাভ কী হল আপনার? তার উপর রামন বোধহয় ভাবেননি, যে ‘স্পিন-মাইন’ বাংলার জন্য সযত্নে পুঁতেছিলেন, ওই একই ‘মাইন’ তাঁর টিমকেই উল্টে রঞ্জি ট্রফি থেকে উড়িয়ে দেবে! আর ওড়াবেন এমন একজন, যাঁকে তিনি তিরিশোর্ধ্ব তকমা দিয়ে বাতিলের দলে ছুড়ে ফেলেছিলেন দু’বছর আগে। দীপ দাশগুপ্ত-র নির্বাচক কমিটি বাতিল করে দিয়েছিল সৌরাশিস লাহিড়ী এবং রণদেব বসুকে। সৌরাশিসের প্রত্যাবর্তন দেখে ক্রিকেটজীবন আরও দীর্ঘায়িত করা যেত কি না, তা নিয়ে আর এখন ভাবেন না রণদেব। বরং এ দিন বললেন, “আমি চাইনি লোকে বলুক, এ এখনও যাচ্ছে না কেন? তা ছাড়া তখনকার নির্বাচক কমিটি আমাকে বাদ দিয়ে বলেওনি, আমার ফিরে আসার প্যারামিটারটা কী? ক্লাব ক্রিকেটে ক’টা উইকেট নিলে আমি ফিরতে পারব? সত্যি বলতে আমার চেয়ে কোনও জুনিয়র চোট পেলে তবে আমি খেলব, মেনে নিতেও পারতাম না।”
রণদেব সরে গিয়েছিলেন। সৌরাশিস যাননি। প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন সাত উইকেট তুলে। ঠিক যতটা নাটকীয় আবার বাংলার ম্যাচে প্রত্যাবর্তন। আর সেই প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে বুধবার, নতুন বছরের প্রথম দিন যা যা ঘটল, সে সবও কম আকর্ষক নয়। গত রাতে বাংলা অধিনায়ক বা কোচ কেউ ঘুমোতে পারেননি। টেনশনের চোটে স্নান না করে মাঠে চলে যান দলের অর্ধেক ক্রিকেটার। মাঠে পৌঁছেই টিমের ম্যানেজার দেবব্রত দাস ছোটেন সোজা ম্যাচ রেফারির ঘরে। শাসিয়ে আসেন, আম্পায়াররা আর বেগড়বাই করলে বাংলা সোজা টিম তুলে নেবে! আর অশোক? গতকালই ম্যাচ পিচে একটা ‘স্পট’ আবিষ্কার করেছিলেন। এ দিন সকালে প্র্যাকটিস পিচে স্পিনারদের নিয়ে সেই একই জায়গায় ‘স্পট’ নির্দিষ্ট করে বল ফেলে যেতে বলেন। পরে ম্যাচেও।
বাকিটা স্বপ্নপূরণ।
তবু একটা সময় টেনশন তৈরি হয়েছিল। ১৫৮-৯ হয়ে যাওয়ার পরেও মরণ-কামড় দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে তামিলনাড়ু। রঙ্গরাজন এবং শ্রীনিবাস দুই স্পিনার মিলে ১৮০ পর্যন্ত পৌঁছেও গিয়েছিলেন। সৌরাশিস লাহিড়ী তখন উইকেট পাচ্ছেন না। ইরেশ সাক্সেনা না। ন্যায্য অ্যাপিলেও আম্পায়ারের আঙুল উঠছে না। বিপক্ষকে চমকে দিতে সকালে লক্ষ্মীর স্পিন বোলিং করার থিওরি, সৌরাশিসের ইতিহাস সবই জলে যাওয়ার দিকে। আচমকাই তখন তরুণ ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে নেন বাংলা অধিনায়ক। বল হাতে দিয়ে বলেন, “চ্যাম্পিয়ন, বাংলাকে কোয়ার্টারে তোলার উইকেটটা তোমার হবে। জীবনের বলটা করে এসো।’
ঋত্বিকের প্রথম বল, বিট। দ্বিতীয় বল, সপাটে পুল করতে গিয়ে রঙ্গরাজনের প্যাডে।
আম্পায়ারের আঙুল উঠবে, না উঠবে না?
উঠবে, না উঠবে না?
টিম এলআরএসের সামনে শেষ আট!

পুরনো খবর:

সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলা ১৩০ ও ১৩৯।
তামিলনাড়ু ৮৫ ও ১৮০ (কার্তিক ৬২, অপরাজিত ৩৩,
বদ্রীনাথ ২১, সৌরাশিস ৭-৬২, ঋত্বিক ২-২৪, অর্ণব ১-৩৪)।
বাংলা ৪ রানে জয়ী।

কী হলে শেষ আটে
বরোদা বনাম রাজস্থান ম্যাচ থেকে বরোদা ছ’পয়েন্ট না পেলেই বাংলা চলে যাবে কোয়ার্টারে। এখন পর্যন্ত ম্যাচের যা পরিস্থিতি, তাতে বরোদার ছ’পয়েন্ট তোলার সম্ভাবনা খুব কম। বরোদার প্রথম ইনিংস ২৩৬ রানের জবাবে রাজস্থান প্রথম ইনিংসে তুলেছে ৩৩৩। দ্বিতীয় ইনিংসে বরোদা আপাতত ১১২-৬। বৃহস্পতিবার ম্যাচের শেষ দিন। এবং ছ’পয়েন্ট পেতে বরোদাকে অলৌকিক কিছু ঘটাতে হবে। তার মধ্যে ইউসুফ পাঠানের নামা অনিশ্চিত। শরীর খারাপের কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে ম্যাচের মধ্যে। এ দিন ছাড়া পেয়েছেন।

সামনে কে
মুম্বই বনাম গুজরাত ম্যাচের বিজয়ী টিম। ভলসাদে যে ম্যাচে বৃহস্পতিবার সরাসরি জিততে মুম্বইয়ের চাই সাত উইকেট। গুজরাতের ১০৮ রান।

কোথায় খেলা
আগামী ৮ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি কোয়ার্টার ফাইনাল। চারটে কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে বোর্ডের পক্ষ থেকে। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে। বরোদার মোতিবাগ। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী। লটারি করে জায়গা ঠিক হবে। সে দিক থেকে বাংলা কোয়ার্টারে উঠলে তাদের ম্যাচ ইডেনে পড়ারও একটা সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.