সময় চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও আশার আলো দেখাতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। আর সেই খবরে উদ্বেগ বাড়ছে হাসপাতালের বাইরে ভিড় করে থাকা ভক্ত আর সাংবাদিকদের মধ্যে। অবশেষে ভারতীয় সময় মঙ্গলবার বিকেল। হাসপাতালের বাইরে এলেন কয়েক জন চিকিৎসক। জানালেন দ্বিতীয় বার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে প্রাক্তন ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন মাইকেল শুমাখারের। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে শুমাখারের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকেরা।
তবে তিনি এখনও সঙ্কটমুক্ত নন বলেও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। যে মেডিক্যাল টিম শুমাখারের চিকিৎসা করছেন, রবিবারই তাঁরা জানিয়েছিলেন প্রাক্তন ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়নকে কৃত্রিম কোমায় (চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে মেডিক্যালি ইনডিউসড কোমা) রাখা হয়েছে। প্রচারমাধ্যমে কাছে মেডিক্যাল টিমের অন্যতম চিকিৎসক জঁ ফ্রাঁসোয়া পায়েন জানান, শুমাখারের মস্তিষ্কে গভীর ক্ষত রয়েছে। সেই জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। জায়গাটি ফুলেও গিয়েছে (সোয়েলিং)। এর ফলে ক্ষতস্থানের আশপাশে রক্তনালীর উপরে প্রবল চাপ পড়ছিল। ফলে শুমাখারের অবস্থা আরও সঙ্কটজনক হতে পারত। রক্তনালীর উপর চাপ পড়ায় নালী ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। বাধা পেত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক রক্তচলাচল। আর সেই কারণেই তড়িঘড়ি ওষুধ দিয়ে শুমাখারকে কৃত্রিম কোমায় রাখা হয়েছে বলে জানান ফ্রাঁসোয়া। তাঁর শরীরের তাপমাত্রা কৃত্রিম উপায়ে স্বাভাবিকের থেকে অনেক কমিয়ে রাখা হয়েছে বলেও ফ্রাঁসোয়া জানিয়েছেন।
উইল কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নিকোলাস স্কিফ বললেন, “মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে আঘাতের জায়গাটা ক্রমশ ফুলে উঠতে থাকে। কিন্তু মাথার খুলি হাড় দিয়ে তৈরি। ফলে তা বাড়তে পারে না। এ দিকে খুলির ভিতরে থাকা মস্তিষ্ক বাড়তে বাড়তে আশপাশের রক্তনালীগুলির উপরে চাপ দিতে থাকে। সেই কারণে অনেক সময়ে রোগীকে কৃত্রিম কোমায় রাখা হয়। এর ফলে মস্তিষ্কের কাজকর্ম অনেকটাই কমে যায়। কাজ কমে যাওয়ায় শক্তির কম দরকারও পড়ে। ফলে মস্তিষ্কে রক্তচলাচল কমে যায়। রক্তনালীগুলোও অপেক্ষাকৃত চুপসে যায়। খুলির ভিতরে অনেকটা জায়গা বাড়ে। তখন মস্তিষ্কের কোনও অংশ ফুলে গেলেও অবস্থা ততটা সঙ্কটজনক হয় না।” যদিও এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকরী তা নিয়ে অনেক চিকিৎসকের মধ্যেই দ্বিমত আছে।
মেডিক্যাল টিমের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যাতে মস্তিষ্কের উপর চাপ না পড়ে তাই শুমাখারের দেহে রক্ত চলাচল কম করার চেষ্টা চলছিল। আর সেই কারণেই তাঁর দেহের উষ্ণতা ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেই রাখা হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় বার অস্ত্রোপচার বা কৃত্রিম কোমায় রেখেও শুমাখার কবে সুস্থ হবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত জানাতে পারছেন না চিকিৎসকেরা।
বরং তাঁদের কথায়, আরও ৪৮-৭২ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। হাসপাতালে সব সময় তাঁর পাশে রয়েছেন স্ত্রী করিনা, মেয়ে জিনা আর ছেলে মিক।
রবিবার ফ্রান্সের আল্পসে তাঁর চোদ্দো বছরের ছেলে মিককে নিয়ে স্কি করার সময় আচমকা পড়ে গিয়ে পাথরে মাথা ঠুকে গিয়েছিল শুমাখারের। প্রথমে আঘাত ততটা গুরুতর বলে মনে হয়নি। হেলিকপ্টারে শুমাখারকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে দেখে এক ঘণ্টা পরেই স্থানান্তরিত করা হয় ফ্রান্সের অন্যতম বড় হাসপাতাল গ্রেনোবেল-এ। সেখানে পৌঁছনোর সময়ই কোমায় চলে যান শুমাখার। দুর্ঘটনার সময়ে হেলমেট পরে ছিলেন শুমাখার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন তিনি। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, আঘাতের চোটে হেলমেটে চিড় ধরে যায়। শুমাখারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েও হেলমেট চুঁইয়ে রক্ত পড়ছিল।
সাত বারের ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন শুমাখারের ৩ জানুয়ারি ৪৫-এ পা দেওয়ার কথা। তার আগে এই দুর্ঘটনায় হতবাক শুমাখারের পরিবার থেকে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্ত। শুমাখারের সতীর্থ থেকে শুরু করে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল টুইটার, ফেসবুকে সবার একটাই প্রার্থনা। ট্র্যাকের রেসের মতোই শুমাখারের জীবনের দৌড়ও যেন এত তাড়াতাড়ি শেষ না হয়ে যায়। আর হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে শুয়ে তাঁর হেলমেটের লেখাটার মতোই শুমাখারও যেন তাঁর ভক্তদের উদ্দেশে বলছেন, “জীবনটাই একটা প্যাশন। আমার সেই প্যাশন ভাগ করে নেওয়ার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।”
|