বাঁশি হাতে ২২ পুরুষ সামলে সেরা কণিকাই
যে কোনও মুহূর্তে গ্যালারি থেকে উড়ে আসতে পারে ইটের টুকরো বা চটি-জুতো। নিদেনপক্ষে অশ্রাব্য গালিগালাজ। তাঁকে লক্ষ করে। যদি তিনি একটাও ভুল করেন।
আর মাঠের মধ্যে? চার পাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘রংবাজ’ সুয়োকা। ‘বদমেজাজি’ জেমস মোগা। সিদ্ধান্ত মনমতো না হলে রেফারির দিকে তেড়ে যাওয়ায় যাঁরা কুখ্যাত।
ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো বড় দলের ম্যাচে এমন পাহাড়প্রমাণ চাপে অনেক সময়েই অসহায় দেখায় বহু বাঘা রেফারিকে। কিন্তু ২০১৩-র শেষ বিকেলে কলকাতা ময়দানে তৈরি হল একেবারে আনকোরা এক চিত্রনাট্য। যাকে কেউ বলছেন উলটপুরাণ। কেউ বলছেন ইতিহাস। কেউ বলছেন, ময়দানের ঘাসে নারী-বিপ্লব।
আজ দিনটা ছিল রেফারি কণিকা বর্মনের।
বয়স বড়জোর বছর কুড়ি। বেঁটেখাটো চেহারা। মঙ্গলবার এই মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বাইশ পুরুষ ফুটবলারকে সামলানোর জন্য। যাঁদের অন্যতম, মোগা পুরনো রেকর্ড বজায় রেখেই তাঁর দিকে কুত্‌সিত অঙ্গভঙ্গি করলেন। ইস্টবেঙ্গল বনাম রেলওয়ে এফসি ম্যাচে গ্যালারিতে ছিলেন কয়েক হাজার অধৈর্য দর্শক। সব সামলে সসম্মানে উত্তীর্ণ শিলিগুড়ির অদূরে শালুগাড়ার কণিকা। মারমুখী ফুটবলারদের সামলে পেনাল্টিও দিয়ে দিলেন বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে। ম্যাচ শেষে বুক চিতিয়ে বলেও গেলেন, “পেনাল্টি দিয়ে ঠিকই করেছি। ওটা পেনাল্টিই ছিল।” আর হ্যাঁ, ভারতে স্মরণকালের মধ্যে কোনও মহিলা রেফারি এই পর্যায়ের ম্যাচ খেলিয়েছেন বলে জানা নেই।
চলছে খেলা। বদমেজাজি জেমস মোগার পাশে কণিকা বর্মন।
মঙ্গলবার ইস্টবেঙ্গল মাঠে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
তবে কারও কারও মনে হচ্ছে, মেয়ে হিসেবে খাতায়-কলমে রেকর্ড সৃষ্টির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এক বার্তা দিয়ে গেল ময়দানে কণিকার দাপুটে পদচারণা। সেই বার্তা নির্ভীকতার। চোখে চোখ রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার। সেই বার্তা দিন বদলের। নির্ভয়ার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে দিন কয়েক আগে। মধ্যমগ্রামে দু’বার গণধর্ষিতা হয়ে গায়ে আগুন দেওয়া কিশোরী মারা গিয়েছেন এ দিন। দেশ জুড়ে প্রতি দিনই কোথাও না কোথাও চলছে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। কণিকা সে সব কিছুর বিরুদ্ধে এ দিন এক জুতসই জেহাদ ঘোষণা করলেন বলেই মত অনেকের।
রাজবংশী পরিবারের মেয়ে পেশায় ‘গ্রিন পুলিশ’। পুলিশ বলেই কি এত দাপট? শুনে কঠিন মুখেও হাসি খেলে গেল। উজবেকিস্তানের ফিফা রেফারি রাভশান ইরমাতভের ভক্তটি খেলা শেষে খিদিরপুরের পুলিশ ব্যারাকে ফেরার আগে বললেন, “বাংলার রেফারি সংস্থার সচিব উদয়ন স্যার আর বাবা বলে দিয়েছিলেন ‘মাঠে আজ তুমিই শেষ কথা’। সেই রাশটাই হাত থেকে বেরোতে দিইনি।”
চনমনে ফিটনেস নিয়ে বলের পাশে থাকলেন সারা ক্ষণ। সাতাশ মিনিটে ইস্টবেঙ্গলের অনুকূলে পেনাল্টি দেওয়ার পর রেলের ফুটবলাররা ঘিরে ধরে প্রতিবাদ জানানোর সময়ও পরিস্থিতি সামাল দিলেন ঠান্ডা মাথায়। ভয় করেনি? আগুনে দৃষ্টি হেনে কণিকার পাল্টা, “ভয় করবে কেন?” তা হলে কি বাইশ জন পুরুষকে বাঁশি হাতে সামলানোটা অবচেতন মনে কিছুটা হলেও আত্মতৃপ্তি আনছে?” মানতে নারাজ কণিকা। বলছেন, “এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তো পাল্টানো দরকার সবার আগে।”
ম্যাচ শেষে সুয়োকা বলে গেলেন, “দারুণ রেফারিং। পেনাল্টিটা দিল নির্ভয়ে।” মোগার অভব্যতা নিয়ে কণিকা কোনও  মন্তব্য করতে চাননি। তবে ৪-১ জিতে ফেরা লাল-হলুদ কোচ আর্মান্দো কোলাসো সেই প্রসঙ্গে বললেন, “একদম ঠিক করেনি। আমি মোগার হয়ে ক্ষমা চাইছি।”
ইউরোপ-এশিয়ায় আকছার হলেও ভারতীয় ফুটবলে মহিলা রেফারি হাতে গোনা। জাতীয় স্তরে গোয়ার মারিয়া রেবেলো ফিফা রেফারি। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের টুর্নামেন্ট আই লিগের প্যানেলেও রয়েছেন। কিন্তু এখনও তাঁকে নামানোর ঝুঁকি নিতে পারেনি সর্বভারতীয় রেফারি বোর্ড। সে দিক দিয়ে দেখলে ফেডারেশনের আগেই অনন্য নজির গড়ে ফেললেন বাংলার রেফারি সংস্থার উদয়ন হালদার, প্রদীপ নাগরা। এমনকী খবরটা পেয়ে মারিয়াও উচ্ছ্বসিত। বললেন, “দেশের সব মহিলা রেফারিই তো এই দিনটার অপেক্ষায় ছিল। ২০১৩-র শেষ দিনটার ডায়েরি কণিকার জন্যই আজ রাতে পার্টি সেরে লিখতে বসব।”
ফেডারেশনের রেফারি কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ নাগ তাঁর ‘পাহাড়ি’ (এই নামেই আদর করে ডাকেন) সম্পর্কে বলেই দিলেন, “জোশের জন্যই মেয়েটা আজ এই জায়গায়। গত রাতে ওকে বলে দিয়েছিলাম রুল বুকের ১২ নম্বর ধারা (অবৈধ আচরণ) ভাল করে দেখে মাঠে আসতে। ভালই তো খেলাল।” কণিকার দুই মেন্টরের অন্যতম, রাজ্য রেফারি সংস্থার সচিব উদয়ন হালদার বললেন, “ওকে নিজের বাড়িতে রেখে তৈরি করেছি। দ্রুত উন্নতি করছে। খুব সিরিয়াস।” শালুগাড়া থেকে কণিকার বাবা সরেন বর্মন আনন্দবাজারকে বললেন, “আজকের দিনটা মেয়ের জন্য ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখব। অবশ্যই স্মরণীয় দিন। দেখতে চাই ও আই লিগ খেলাচ্ছে।”
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী বঙ্গতনয়ারা শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিয়েছেন কণিকাকে। যাঁদের কেউ কেউ বলছেন, একটা ‘অর্ধেক আকাশে’র সীমানা আরো একটু বিস্তৃত করে দিলেন উত্তরবঙ্গের দামাল। ফুচকা বিক্রেতা থেকে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, যুদ্ধবিমানের পাইলট থেকে রাষ্ট্রপতির দফতরে গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী সব জায়গাতেই তো পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পেশাগত দুনিয়ায় মহিলারাও উঠে এসেছেন তরতরিয়ে। তার সঙ্গে জুড়ল হাইভোল্টেজ ফুটবল ম্যাচে রেফারিং।
সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য কণিকার কথা শুনেই বললেন, “নতুন বছরে পা দেওয়ার আগেই উপহার পেয়ে গেলাম। দারুণ খবর। গর্বেরও।” ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ঝুলন গোস্বামীর আবার মনে পড়ছে ইংল্যান্ডে দেখা এক মহিলা রেফারির কথা। বললেন, “সে দিন হোটেলে ফিরে বলেছিলাম, আমাদের দেশে এ রকম কোনও দিন হবে কি? আজ সেটাই সত্যি হয়ে গেল।” ঝুলন কণিকাকে ফিফা প্যানেলে দেখতে চান।
এভারেস্ট জয়ী বঙ্গকন্যা ছন্দা গায়েন আলিপুরদুয়ারে বসে খবরটা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “আমি এভারেস্টে উঠেছিলাম। বছরের শেষ দিনে ওই মহিলা রেফারিও এভারেস্টে উঠে পড়লেন!” বাচিক শিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়েরও বিস্ময় কাটছে না। প্রতিবাদী মহিলাদের যন্ত্রণার কবিতা হামেশাই শোনা যায় যাঁর কণ্ঠে, সেই ব্রততী বলছিলেন, “মেয়েটা তো রেকর্ড করল। পথে-ঘাটে মহিলাদের চলাফেরা করতে আত্মবিশ্বাস আরও বাড়বে।” রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজাও বলছেন, “মহিলাদের ফুটবল খেলা আগেও দেখেছি। কিন্তু এই মেয়েটা কি না পুরুষদের একটা ম্যাচ খেলাল। নারীদের জাগরণ আরও গতি পাবে ওর এই সাফল্যে।”
আর যাঁকে নিয়ে এত হইচই, বছর শেষের সন্ধ্যায় সেই কণিকার নতুন বছরের পরিকল্পনাও এই ‘জাগরণের’ লক্ষ্যেই। বলছেন, “উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিতে হবে। মহিলারা অর্থ আর শিক্ষা, এই দু’টো ব্যাপারে স্বাবলম্বী হতে পারলে কেউ তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।”
ফিফা প্যানেলে ঢোকার সঙ্গে এই স্বপ্নও নতুন বছরে সঙ্গী কণিকার।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.