বিহারেও কেএলও, নাশকতা রুখলেন দুই রেলকর্মী
ত্তরবঙ্গ লাগোয়া বিহারের কাটিহার-পূর্ণিয়াতেও নিজেদের প্রভাব প্রমাণ করতে মরিয়া কেএলও। মালদহের অদূরে বিহারের আজমনগরে রেলসেতুতে বড় মাপের বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্র তারাই করেছিল বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সন্দেহ। তবে দুই রেলকর্মীর তৎপরতায় চক্রান্ত ভেস্তে গিয়েছে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে উত্তরবঙ্গগামী কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস।
তাতেও অবশ্য দুশ্চিন্তা কমেনি। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ মালদহের আদিনা স্টেশনের অদূরে রেল লাইন থেকে এক মিটার দূরে একটা ব্যাগের মধ্যে চৌকো দু’টো বাক্স পড়ে থাকতে দেখেন এক রেলকর্মী। ওই বাক্স থেকে তার বেরিয়ে থাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। ওই লাইনে ট্রেন চলাচল থামিয়ে রেলপুলিশ, বম্ব স্কোয়াড গিয়ে তল্লাশি শুরু করে। পরে দেখা যায়, ওই বাক্সে বিস্ফোরক নেই। দু’টো সুইচ বোর্ড রাখা ছিল ব্যাগে। ডিআরএম কাটিহার জানান, ওই ব্যাগে বা বাক্সে কোনও বিস্ফোরক ছিল না। তবে পুলিশ কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। ওই লাইনে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে পুলিশি তল্লাশি চলে। রেল চলাচল স্বাভাবিক হয় বেশ কিছুক্ষণ পরে।
নাশকতার বিস্তারিত...
রেলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেন ওই নাশকতার চেষ্টার ব্যাপারে আগাম কোনও তথ্য পায়নি? শুধু তা-ই নয়, রেলের তরফে লাইনে পাতা বিস্ফোরককে ‘কম শক্তি’র বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু আসলে ওই বিস্ফোরক যে খুবই শক্তিশালী, সেই তথ্যও পৌঁছেছে রাজ্য সরকারের কাছে। গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার অভিযোগ শুনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ ও কলকাতার মধ্যে সংযোগকারী প্রতিটি ট্রেনের যাত্রাপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ্যের তরফে গোটা বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামীকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানান, যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে কোনও গাফিলতি যে মেনে নেওয়া যাবে না, সে কথা রেলের নিরাপত্তা বিভাগের শীর্ষ অফিসারদেরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, “রেল সুরক্ষা পর্ষদ এবং আরপিএফ এ ব্যাপারে তদন্ত করছে। নাশকতা রুখতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সব রকমের সহায়তা করা হবে।”
কেএলও যে তাদের জাল ক্রমশ ছড়াচ্ছে, প্রাথমিক তদন্তের পরে গোয়েন্দারা সে খবর পেয়েছেন। রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের একটি সূত্র দাবি করছে, সম্প্রতি কেএলও প্রস্তাবিত কামতাপুর রাজ্যের মধ্যে গোটা উত্তরবঙ্গ ও অসমের ৪টি জেলা ছাড়াও কাটিহার ও পূর্ণিয়ার কিছু অংশও জুড়েছে। তাই বিহারে ওই দু’টি এলাকাতেও যে তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে, তা কেএলও প্রমাণ করতে সক্রিয় বলে রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের সন্দেহ। কিন্তু তারা সেখানে নাশকতার ছক কষার পরে তা কেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা রেলের গোয়েন্দা বিভাগ টের পায়নি, সেই প্রশ্নেই উদ্বেগ বেড়েছে রেলের কাটিহার ডিভিশনের অফিসার-কর্মীদের। কাটিহার ডিভিশনাল রেলওয়ে সেফটি কমিশনার বি কে অঙ্গামি এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সুগত লাহিড়ি জানান, রেললাইনের নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উপরে থাকে। তার ভিত্তিতে সতর্কতাও নেওয়া হয়। অঙ্গামি বলেন, “রাজ্যের তরফেই সতর্কবার্তা রেলের কাছে আসে। তবে কেন্দ্রের গোয়েন্দাদের তরফেও সতর্কবার্তা আসে। এ ক্ষেত্রে কী হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের এক পদস্থ কর্তা জানান, উত্তরবঙ্গ ও নমনি অসমে কেএলও এবং তাদের সহযোগীরা সক্রিয় হওয়ার পরে নাশকতার চেষ্টার ব্যাপারে নিয়মিত নানা সতর্ক-বার্তা দেওয়া হচ্ছে। অথচ আজমনগরের মতো এলাকায় যে ওই ধরনের ঘটনার চক্রান্ত করা হতে পারে, সেই ব্যাপারে আগাম কোনও বার্তাই গোয়েন্দারা দিতে পারেননি। উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের পক্ষ থেকে গোটা ঘটনাটি রেলের নিরাপত্তা বিভাগকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একঝলকে দেখে নেওয়া যাক সোমবার কোথায়, ঠিক কী ঘটেছিল?
উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের কাটিহার ডিভিশনের একটি ছোট্ট স্টেশন আজমনগর। যেখানে সাধারণত এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ায় না। স্টেশন থেকে ৫০০ মিটার দূরে কয়েছে ছোট নদী শালমারা। নদীর উপরে রয়েছেন বহু পুরানো একটি রেল সেতু। সেতুটি লোহার তৈরি। ইদানীং ছোট সেতুতে যে ইস্পাতের কাঠামো ও রেলিং থাকে, তা সেখানে নেই। ওই সেতুতে যাতায়াতের মুখে একদিকে আপ লাইনের (এনজেপিগামী) মধ্যে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও একটি প্রেসার বোমা (যা চাপ পড়লেই ফেটে যায়) রাখা ছিল। একই ভাবে সেতুর অন্য দিকেও লাইনের ঠিক মাঝে ১টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও একটি প্রেসার বোমা রাখা ছিল।
রেল সূত্রের খবর, ওই সেতু দিয়ে গুয়াহাটিগামী ব্রহ্মপুত্র মেল নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা দেরিতে গিয়েছে। ঠিক পিছনেই ছিল ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ারগামী কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। ট্রেনটি ঘন্টাখানেক দেরিতে চলছিল। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের ওই সেতু পার হওয়ার কথা ছিল পৌনে ৬টা নাগাদ। সাড়ে ৫টা নাগাদ কর্তব্যরত রেলকর্মী রফিকুল ইসলাম লাইন পরীক্ষার সময়ে সেতুর দু’দিকে বোমা দেখতে পেয়ে আজমগর স্টেশনে খবর পাঠান। ততক্ষণে স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় কাঞ্চনকন্যা। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটি স্টেশনে থামানো হয়। কর্তব্যরত রেলকর্মীরা গ্রামবাসীদের সাহায্যে লম্বা বাঁশ দিয়ে বিস্ফোরক দু’টি সরানোর চেষ্টা করতে হ্যান্ড গ্রেনেড দু’টি ফেটে যায়। বিস্ফোরণের ধাক্কায় রেল লাইনের পাথর কিছুটা ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রেলকর্মীরা লাইনের ঢালের নীচের দিকে দাঁড়িয়ে থাকায় সেই পাথরের টুকরোর আঘাত থেকে রক্ষা পান। এর পরে রেলের বম্ব স্কোয়াড গিয়ে অন্য দু’টি বোমা ফাটিয়ে দেয়।
রেলের অফিসার-কর্মীদের অনেকেই জানান, যে হ্যান্ড গ্রেনেড দু’টি পাওয়া গিয়েছে, তা বিদেশে তৈরি বলে জানা গিয়েছে। ‘প্রেসার বোমা’ দু’টি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন না হলেও, মাঝারি মানের ছিল। আর তা ভোর ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার আগেই রাখা হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারী অফিসারদের অনেকেই। অর্থাৎ কুয়াশা ঘেরা ভোরের সুযোগ নিয়ে বিস্ফোরকগুলি রাখা হয় বলেও সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে তদন্তকারীদের।
যদি বোমা ও হ্যান্ড গ্রেনেড শনাক্ত না হত, তা হলে কী ঘটতে পারত?
রেলের একাধিক পদস্থ অফিসার জবাব দিতে গিয়ে শিউরে উঠেছেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, ওই রেল সেতুটি পুরনো। ফলে সেতুতে ওঠার মুখে বিস্ফোরণ ঘটলে ইঞ্জিনের বড় কোনও ক্ষতি হয়তো হতো না। কারণ, ইঞ্জিনের তেলের ট্যাঙ্ক পুরু ইস্পাতের চাদরে মোড়া থাকে। তবে বিস্ফোরণের ঝাঁকুনিতে ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হতে পারত। তা যদি না-ও হত, কোনওমতে ইঞ্জিন ছোট মাপের সেতুটি পার হলে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের অভিঘাতে বেশ কয়েকটি কামরা সেতু থেকে নদীতে পড়ে যেতে পারত।
উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “বোমা ও হ্যান্ড গ্রেনেড চিহ্নিত না হলে বেশ কয়েকটি কামরা লাইন থেকে গড়িয়ে পড়তে পারত। সেতুতে রেলিং না-থাকায় নীচেও কামরা পড়ত। এমনকী, সেতুটি দুমড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল। সে ক্ষেত্রে আপ লাইনটি বন্ধ হয়ে যেত। সব মিলিয়ে বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি হত। ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হত। গোয়েন্দারা কেন নাশকতার চেষ্টার ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারলেন না, সেটাই বুঝছি না।”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.