জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর-বজরাপাড়ার মতো কোনও ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এর শক্তিশালী বিস্ফোরণ নয়, নেহাতই পেটো বোমা। আবার জলপাইগুড়ির মতো সন্দেহের তির কেএলও-র মতো কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠনের দিকে নয়, এ ক্ষেত্রে পুলিশ সন্দেহ করছে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জলপাইগুড়ির চেয়ে অনেক কম জখম তিন জন। কিন্তু কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকায় পরপর দু’দিনে মোট ২৪টি তাজা বোমা উদ্ধার হওয়ার ঘটনা কার্যত ঘুম কেড়েছে লালবাজারের গোয়েন্দাদের। তাঁদের একাংশের বক্তব্য, অতগুলি বোমা উদ্ধার হওয়া আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র, আরও বড় কিছু যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে ওই এলাকায়।
লালবাজার সূত্রে খবর, বোমা উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে ফের উঠে এসেছে টালিগঞ্জ-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় এক সময়ে ত্রাস কায়েম করা স্বপন দে ওরফে শ্মশান স্বপন ও শ্রীধর দাস ওরফে মাস্টারের নাম। যদিও আপাত ভাবে দু’জনেই অন্ধকার-জগৎ ছেড়ে প্রোমোটারি ও অন্যান্য ব্যবসা করছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।পুরসভা, বিধানসভা কিংবা লোকসভা ভোটের ঠিক মুখে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা উদ্ধারের ঘটনা শহরে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভোটের দিন সম্ভাব্য সংঘর্ষের প্রস্তুতি হিসেবে ওই সব অস্ত্রশস্ত্র মজুত করে। কিন্তু সামনে ভোট বলতে শুধু লোকসভা নির্বাচন, তা-ও কয়েক মাস দূরে। আবার বোমাগুলি বহু দিন আগে জড়ো করে রাখা ছিল, এখন হঠাৎ পাওয়া গিয়েছে, তা-ও নয়। তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন, খুব সম্প্রতিই সেগুলি মজুত করে রাখা হয়েছে। তা হলে ওই বোমা ওখানে মজুত করার উদ্দেশ্য কী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গোয়েন্দাদের একাংশ যা জেনেছেন, তাতে তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও দ্বিগুণ হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, টালিগঞ্জ এলাকায় দু’দল দুষ্কৃতীর মধ্যে সম্প্রতি শত্রুতার মাত্রা অনেকটাই বেড়েছে এবং দু’দলই একে অন্যের উপর হামলার প্রস্তুতি হিসেবে বোমা-গুলি-বন্দুক মজুত করতে শুরু করেছে। ওই ২৪টি বোমা তার-ই সামান্য অংশ বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন।
যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) দমন পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “আমরা সমস্ত দিকই খতিয়ে দেখছি। দু’দল দুষ্কৃতীর মধ্যে সংঘর্ষের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ওই সব বোমা মজুত করা হয়ে থাকতে পারে। এর পিছনে কাদের হাত আছে, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
শনিবার ৫৪ নম্বর টালিগঞ্জ রোডে একটি বোমা ফেটে জখম হয় তিন কিশোর। এক জন, সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রের ডান হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছে। তার পরেই ওই জায়গা থেকে আরও চারটি বোমা মেলে। আবার তার পরদিন ওই জায়গার পাশেই ১৩ নম্বর বাওয়ালি মণ্ডল রোডে একটি বাড়ির চারতলা থেকে উদ্ধার হয় আরও ২০টি বোমা। একটি খবরের ভিত্তিতে সোমবার লালবাজারের বম্ব স্কোয়াডের অফিসারেরা টালিগঞ্জ রোডের আরও কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালান। আর অবশ্য বোমা মেলেনি।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত এক জনকেও ওই বোমা মজুত করার ঘটনায় গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
তবে এলাকায় হামলার জন্য অস্ত্রশস্ত্র মজুত করার ব্যাপারে গোয়েন্দারা শ্মশান স্বপন ও শ্রীধর ওরফে মাস্টারের পুরনো শাগরেদদের দিকেই আঙুল তুলেছেন। লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখার এক অফিসারের বক্তব্য, “স্বপনের কিছু পুরনো শাগরেদ যেমন গুটকে, সূরয, রাজা এরাই ওই বোমা মজুত করেছিল বলে প্রাথমিক ভাবে আমরা খবর পেয়েছি। এলাকায় প্রোমোটারি এবং নির্মাণশিল্পে মালমশলা জোগান দেওয়া নিয়ে শ্রীধরের দলের সঙ্গে তাদের বিরোধ সম্প্রতি তীব্র আকার নিয়েছে। হামলার জন্যই প্রস্তুতি হিসেবে বোমা মজুত করেছিল গুটকেরা।” আবার গোয়েন্দা বিভাগের আর এক অফিসার বলেন, “শ্রীধরের কয়েক জন পুরনো ছেলে এখনও টালিগঞ্জ রোডে সক্রিয়। এটা তাদেরও কাজ হতে পারে। দু’পক্ষের ভূমিকাই খতিয়ে দেখতে হবে।”
বছর দেড়েক আগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া খোদ স্বপন দে ওরফে শ্মশান স্বপন মঙ্গলবার বলেন, ‘‘যে সব এলাকা থেকে বোমা পাওয়া গিয়েছে, সেখানে আমি যাই না, আমার লোকজন ঢোকে না। গুটকে তো যায়-ই না। ওটা শ্রীধর বাহিনীরই কীর্তি।” আর শ্রীধর বলেন, “কেন আমাকে ফোন করছেন? ওই ঘটনার সঙ্গে আমার কোনও যোগ নেই। প্রয়োজন হলে যা বলার আদালতেই বলব।”
নিজেদের দাপটে এলাকা দখলে রাখতে এই ধরনের দুষ্কৃতীদের মদত দেওয়ার অভিযোগ বরাবরই ওঠে নেতাদের বিরুদ্ধে। ওই এলাকা রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। স্থানীয় বিধায়ক তথা বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমি বা আমার সহযোগীরা স্বপন, শ্রীধর সকলের সংস্রবই এড়িয়ে চলি। পুলিশকে বলেছি, দুষ্কৃতীরা যে দলেরই ঘনিষ্ঠ হোক, তাদের গ্রেফতার করতে হবে।” কিন্তু বোমা মজুত করার পিছনে কোন দলের হাত আছে? শোভনদেববাবুর বক্তব্য, “ওই এলাকায় এখন শ্রীধরের লোকজনেরই দাপট, স্বপনের নয়।” ওই এলাকা আবার কলকাতা পুরসভার ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ছে। স্থানীয় কাউন্সিলর তথা দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী মালা রায় বলেন, “স্বপন, শ্রীধর দু’জনের ছেলেদের হাতেই বোমা-বন্দুক আছে। তবে যে দু’টি এলাকা থেকে বোমা মিলেছে, সেই দু’টি এলাকাই শ্রীধরের বলে পরিচিত। পুলিশ সব জেনেও নিষ্ক্রিয়।”
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার ওই জায়গায় আশির দশক, নব্বইয়ের দশক ফিরে আসতে চলেছে। তবে সে ক্ষেত্রে এ বার সামনে থাকবে স্বপন, শ্রীধরের শাগরেদরাই।” |