|
|
|
|
বিস্ফোরণ আটকে আরও কঠোর প্রশাসন
নিজস্ব প্রতিবেদন |
নাশকতা রুখতে পুলিশ-প্রশাসন কড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু আতঙ্কের শেষ হয়নি। বরং রবিবার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ ও লাগোয়া বিহারের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের দিন কাটল বোমাতঙ্ক ও তোলা আদায়ের হুমকি ফোনে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সন্দেহের আঙুল উঠেছে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) এবং তাদের সহযোগীদের দিকে। তবে নজরদারি ও সতর্কতা কয়েক গুণ বাড়ায় নাশকতা বা টাকা আদায়ের ছক, কোনওটাই সফল হয়নি।
যেমন, এ দিনই মালদহের অদূরে বিহারের আজমনগরে রেললাইনে বোমা থাকলেও রেলকর্মীদের তৎপরতায় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে। রেল সূত্রের খবর, ভোরে লাইন পরীক্ষার সময়ে চারটি বোমা দেখতে পান দুই রেলকর্মী। ওই লাইনেই আসছিল এনজেপি-মুখী কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। সেটি আজমনগর রোড স্টেশনে থামিয়ে দেওয়া হয়। থামানো হয় আরও ১০টি ট্রেন। রেলকর্মীরা বাঁশ দিয়ে সরানোর সময়ে বোমাগুলি ফেটে যায়। ডিআরএম (কাটিহার) অরুণকুমার শর্মা বলেন, “বোমাগুলি দেশি হলেও তা একযোগে ফাটলে ইঞ্জিনে আগুন ধরে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল।” তিনি জানান, বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ওই এলাকায় রেল লাইনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সরকারি সূত্রের খবর, এলাকাটি বিহার রেল পুলিশের আওতায়। কিন্তু লাইনটির গুরুত্বের কথা ভেবে এ রাজ্যেও রেল পুলিশ ওই এলাকায় নজরদারি বাড়াবে। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও বলেছেন, “নাশকতা রুখতে রেল সব সময় সচেষ্ট। এ ব্যাপারে রাজ্যকে সাহায্য না করার কোনও কারণ নেই।” নাশকতা যে রেলের নজরদারির জন্যই এড়ানো গিয়েছে, সেই যুক্তি দেখিয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের এক মুখপাত্রের দাবি, “স্পর্শকাতর এলাকায় লাইন রক্ষণাবেক্ষণের দল রয়েছে। ঘণ্টা তিনেক অন্তর টহল দেয় তারা। পাঠানো হয় পাইলট ইঞ্জিনও।”
বোমাতঙ্কের আর একটি ঘটনা ঘটে আপার চালসায়, ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে। প্রায় আট ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল জাতীয় সড়কে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যাগটি থেকে থালা-বাসন, জামা-কাপড় মেলে। এরই মধ্যে রবিবার শিলিগুড়ির ঘোষপুকুর এলাকার একটি কাগজের কারখানা কর্তৃপক্ষকে তোলা আদায়ের হুমকি দেওয়া হয়। পরে ফাঁসিদেওয়া থানায় তাঁরা অভিযোগ করেছেন। কাঠগড়ায় কেপিপি। ওই রাতেই ডুয়ার্সের শামুকতলা এলাকার প্লাইউড ব্যবসায়ী তথা এক সিপিএম নেতাকে হুমকি দিয়ে টাকা চাওয়ার অভিযোগ ওঠে কেএলও-র বিরুদ্ধে। দু’টি অভিযোগেরই তদন্ত করছে পুলিশ।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের পক্ষ থেকে উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলার পুলিশ-প্রশাসনকে কেএলও এবং তাদের সহযোগীদের যত জনকে সম্ভব দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জলপাইগুড়ি-কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিবার কামতাপুর পিপলস পার্টি (কেপিপি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক নুবাস বর্মনকে এবং মালদহের বামনগোলায় বাসে গুলি চালনার ঘটনায় কেপিপি-র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি সুভাষ বর্মনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও সব অভিযোগ উড়িয়ে কেপিপি-র সভাপতি অতুল রায়ের দাবি, “আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলছে।” পুলিশ সূত্রের খবর, কেএলও-র মদতদাতা সন্দেহে আরও অন্তত পাঁচ জন চিহ্নিত হয়েছেন। তদন্তকারী অফিসারদের কয়েক জন জানান, একাধিক কেএলও লিঙ্কম্যানকে জেরা করে জঙ্গি কার্যকলাপে প্রতিবেশী একটি দেশ ও পড়শি একটি রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে। তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উপরেও চাপ বাড়িয়েছে রাজ্য।
নবান্ন সূত্রের খবর, আজ, মঙ্গলবার কলকাতায় আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী। ১২টায় নবান্নে তিনি বৈঠক করবেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। থাকবেন বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান এডিজি বংশীধর শর্মাও।
কী নিয়ে আলোচনা হবে তাঁদের? নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে এক দিকে কথা হবে বাংলাদেশ নিয়ে। সেখানে ৫ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচন।
কিন্তু তার আগে সে দেশ জুড়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া সীমান্ত অঞ্চলেও। একই সঙ্গে জলপাইগুড়িতে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ, কেএলও এবং তাদের সহযোগীরা কী ভাবে, কোন দেশ ও রাজ্য থেকে মদত পাচ্ছে, সেই সংক্রান্ত তথ্য সামনে রেখেও আলোচনা হবে।
ভোট ঘিরে বাংলাদেশ যে রকম অশান্ত হয়ে উঠেছে, তাতে উদ্বিগ্ন দিল্লি। কারণ, এর প্রভাব পড়তে পারে দু’দেশের মধ্যেকার বাণিজ্যে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতি হবে ভারতেরই। তারা বছরে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশে, আমদানি করে মোটে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার পণ্য। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, মূলত এই বিষয়টি মাথায় রেখেই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কলকাতায় আসছেন অনিল গোস্বামী। তবে এর থেকে উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক অস্থিরতাকে আলাদা করতে চাইছে না প্রশাসন। তাই, কেএলও এবং তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে রাজ্য যে কঠোর পদক্ষেপ করছে, সেই প্রসঙ্গও উঠবে আলোচনায়। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্ত তো বটেই, নেপালের সীমান্তেও নজরদারি আরও বাড়ানোর পক্ষপাতী রাজ্য সরকার।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নির্বাচন সংক্রান্ত অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে যে ভাবে অনুপ্রবেশের সমস্যা বেড়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় দিল্লিও। বিএসএফ সূত্রের খবর, এর প্রভাব যাতে সীমান্তে না পড়ে, তাই আগেভাগেই চলতি মাস থেকে সীমান্তে ২ ব্যাটেলিয়ন বাড়ানো হয়েছে। এই অতিরিক্ত ব্যাটেলিয়নের একটি মোতায়েন হয়েছে দক্ষিণবঙ্গে। অন্যটি কোচবিহারে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বেড়েছে, সে ব্যাপারেই নজরদারি বাড়াতে এই সিদ্ধান্ত।
বাম আমলে সরকারি তরফে যিনি উত্তরবঙ্গে কেএলও কার্যকলাপ রোখার কাজে তদারক করতেন, সেই প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যও কেএলও এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী। তবে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী একই সঙ্গে তৃণমূল সরকারকেও দূষেছেন। তাঁর দাবি, “তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে কেন এত দিন কেএলও এবং তাদের সহযোগীদের কাজকর্মকে হাল্কা ভাবে দেখা হয়েছে? সে জন্যই মালদহ থেকে ডুয়ার্স হয়ে কোচবিহার সর্বত্র কেএলও জাল বিছিয়ে ফেলেছে।”
উল্টো দিকে, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার কড়া হাতে জঙ্গি তৎপরতা রুখতে চায়। সমস্ত হিংসাত্মক শক্তিকে আমরা রাজনৈতিক ভাবেও মোকাবিলা করব। কে কী বললেন, সে সব নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই।”
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনিক কর্তাদের বৈঠকের দিকে যে আজ সকলেরই নজর থাকবে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
|
পুরনো খবর: মুক্ত ১০-ই মাথাব্যথা, রাজ্য কঠোর হচ্ছে কেএলও নিয়ে |
|
|
|
|
|