ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূল সরকার প্রায় ২৫০ জন রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়েছিল। সেই তালিকায় কেএলও জঙ্গিদের ৪৫ জনের নামও ছিল। তাঁদের মধ্যে ৩৫ জন এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। কিন্তু বাকি ১০ জন কেএলও জঙ্গিই নাশকতার পথে ফিরে গিয়েছেন। ওই ১০ জনকে সামনে রেখেই ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাকে অশান্ত করতে একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে আঁচ করছে রাজ্য সরকার। জলপাইগুড়িতে বিস্ফোরণ ও মালদহে বাসে নির্বিচারে গুলি চালানোর তদন্তে নেমে ওই ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু তথ্যও পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে।
সেই তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে সক্রিয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিও কেএলও-কে মদত দিচ্ছে। পড়শি কিছু রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ঘাঁটি গেড়ে থাকার সাহস কী ভাবে কেএলও পাচ্ছে, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন রাজ্য। তাই এত দিন কেএলও জঙ্গিদের মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য কিছুটা নরম মনোভাব দেখালেও এখন কঠোরতম পদক্ষেপ করতে বদ্ধপরিকর রাজ্য। সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্যের পক্ষ থেকে কেন্দ্রকেও সব কিছু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ রুখতে কঠোর পদক্ষেপ করবে রবিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমরা ক্ষমতায় আসার পরে একটা কমিটি গড়ে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করেছি। তাতে ২৫০ জনের মতো বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। সেই তালিকায় কেএলও জঙ্গিদের অনেকের নামই ছিল। কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে সরকার তাঁদেরও ছাড়ার ব্যবস্থা করেছে।” কিন্তু হিংসা দমনে যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন যে ভাবে উত্তরবঙ্গকে ফের অশান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। তাই হিংসাত্মক কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত সকলকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” সরকারি সূত্রের খবর, আগামী দিনে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কাউকে মুক্তি দেওয়ার আগে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা যাবতীয় অভিযোগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। |
নজরে ১০ |
• জীবন সিংহ ওরফে তমির দাস।
• টম অধিকারী ওরফে জয়দেব রায়।
• মালখান সিংহ ওরফে মাধব মণ্ডল।
• নীলাম্বর রাজবংশী ওরফে মঞ্চলাল সিংহ ওরফে ডাক্তার।
• লালসিংহ ডেকা ওরফে জয়ন্ত রায়।
• নারায়ণ রায় ওরফে তরুণ থাপা।
• জ্যোতিষ রায়।
• প্রদীপ রায়।
• নিত্যানন্দ সরকার ওরফে জামাই।
• পিন্টু বড়ুয়া। |
• জীবন সিংহ, লালসিংহ ডেকা ছাড়া বাকিরা বিভিন্ন সময়ে জেল খেটেছেন।
• তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে টম, মালখান ছাড়া পেয়ে ফেরার।
• বাকিরাও জামিন পাওয়ার পরে ফিরে গিয়েছে জঙ্গি শিবিরে। |
|
মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তা পেয়েই মালদহ ও জলপাইগুড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৫ সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে চন্দন রায় নামে এক জনকে জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, বিস্ফোরণের পরে আত্মগোপনকারী এক কেএলও জঙ্গির সঙ্গে চন্দন মোবাইলে কথা বলেছিলেন। মালদহে বাসে হামলায় মদত দেওয়ার অভিযোগে কেপিপি-র (কামতাপুর পিপলস পার্টি) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ বর্মন ও সদস্য ফলেন বর্মনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলেনের বাড়িতেই ফেরার কেএলও জঙ্গি মালখান সিংহ একাধিক বৈঠক করেছেন বলে পুলিশের দাবি। একই ভাবে মোবাইলের কথোপকথন-সহ নানা সূত্র ধরে উত্তরবঙ্গের ৬ জেলায় ১২টি দল তল্লাশিতে নেমেছে।
সরকারের কড়া মনোভাব বুঝতে পেরে কেপিপি-র পক্ষ থেকেও জলপাইগুড়ির বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ঘেরাও, আইন অমান্য কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। প্রশাসন অনুমতি না-দিলেও আজ, সোমবার ওই আইন অমান্য কর্মসূচি পালনের কথা ছিল কেপিপি-র। কিন্তু, এ দিনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জলপাইগুড়ির নানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। এর পরে কেপিপি-র তরফে অতুল রায় ও নিখিল রায় আলাদা ভাবে হলেও একই সুরে জানান, তাঁরা রক্তারক্তির বিরুদ্ধে। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে আন্দোলন করলে নানা অশান্তি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। তাই আপাতত যাবতীয় কর্মসূচি স্থগিত রাখা হয়েছে।
তবে মূল স্রোতে ফেরা কেএলও জঙ্গি ও লিঙ্কম্যানদের যাতে অহেতুক হয়রান করা না হয়, সেই ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে পুলিশ-প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “যাঁরা আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সামিল হয়েছেন, তাঁদের সব রকম সহায়তা করা হচ্ছে। আগামী দিনেও যাতে তাঁদের কোনও অসুবিধে না হয়, সেটা দেখা হবে।” সেই সঙ্গে কেএলও ও তাদের সহযোগী যে সব সংগঠন আলাদা রাজ্যের দাবিকে সামনে রেখে উন্নয়নে বাধা দিতে চাইছে, তাদের রাজনৈতিক ভাবেও মোকাবিলা করতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, যে ভাবে পাহাড়ে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে জনমতকে নিজেদের অনুকূলে আনতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী, সে ভাবেই উত্তরবঙ্গের ৬ জেলায় লাগাতার মিটিং-মিছিল, জনমুখী কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। সেই মতো জলপাইগুড়িতে নানা এলাকায় শান্তি মিছিল করেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী চেয়ারম্যান গৌতম দেব। গৌতমবাবু বলেছেন, “আমরাও কেএলও এবং তাদের সহযোগীদের জনবিচ্ছিন্ন করব। পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে। সমতলও শান্ত থাকবে।”
জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজ্যের কাছে ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে গিয়েছে বলে বাম শিবিরের অবশ্য দাবি। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “আমরা বহু কষ্টে জঙ্গিদের ধরেছিলাম। তৃণমূল ক্ষমতায় এসে তাদের ছেড়ে দিল। জঙ্গিদের রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে মুক্তি দেওয়া যায় না। তাই ওই সিদ্ধান্ত ব্যুমেরাং হয়ে গিয়েছে।”
ঘটনা হল, কেএলও-র হিংসাত্মক কাজকর্ম নিয়ে কেপিপি-র নেতা-কর্মীদের একাংশের মধ্যেও ক্ষোভ ও আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। কারণ, অতীতে কেএলও-র ফাঁদে পা দিয়ে কেপিপি-র নেতা-কর্মীদের অনেককেই দীর্ঘদিন ঘর ছাড়া থাকতে হয়েছে। গত বিধানসভা ভোটের সময়ে কেপিপি-র একটি বড় অংশ ‘পরিবর্তন’-এর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ফলে, তৃণমূল সরকার গঠনের পরে এত দিন কিছুটা নিশ্চিন্তেই ছিলেন তাঁরা। নতুন করে কেএলও সক্রিয় হওয়ায় ওই নেতা-কর্মীরা ফের পুলিশি জেরার মুখে পড়ার আশঙ্কাও করছেন। কেপিপি-র দুই শীর্ষ নেতা অতুলবাবু ও নিখিলবাবু দু’জনেই বলেছেন, “আমরা আশা করি, বাম আমলের মতো পুলিশ তদন্তের নামে নিরীহদের হয়রান করবে না।” যদিও পুলিশ-প্রশাসনের ডিজি পদমর্যাদার এক জন অফিসার জানান, নিরীহদের হয়রান করার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও অন্তত ৮০ জন কেএলও লিঙ্কম্যানকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অনেককে জেরার সূত্রে নানা তথ্য মিলেছে। জানা গিয়েছে, পড়শি রাজ্যের নানা এলাকায় কেএলও জঙ্গিরা দিনের পর দিন ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে। আর একটি পড়শি রাজ্যের একটি জঙ্গি গোষ্ঠীও কেএলও-কে মদত দিচ্ছে। নেপাল এবং এ দেশের মাওবাদীদের সঙ্গেও কেএলও-র যোগসাজশ ক্রমশ বাড়ছে বলেও পুলিশের সন্দেহ।
অন্য দিকে, অসম পুলিশের ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরীর দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কেএলও-র সে রাজ্যের ঘাঁটি সংক্রান্ত স্পষ্ট তথ্য তাঁদের দেওয়া হয়নি। অসমের ডিজির দাবি, “১৩ ডিসেম্বর কেএলও-র বিষয়ে নবান্নে বৈঠক করি। সেখানে দুই রাজ্যের পুলিশের যৌথ ভাবে কেএলও-র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা হয়েছে। এই রাজ্যের ধুবুরি ও চিরাং জেলায় কেএলও শিবির রয়েছে ঠিক। কিন্তু চিরাং জেলায় তাদের সদর দফতর রয়েছে এমন কোনও তথ্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আমাদের দেয়নি।”
আলফা, এনডিএফবি, এনএসসিএন-এর সঙ্গে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলেও, মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছেন কেএলও-এর মুখপাত্র কৈলাশ কোচ। তাঁর দাবি, “কিষেণজির সময় থেকেই, মাও মতাদর্শের সঙ্গে আমাদের মত ও পথ মেলে না। তাই, একে অন্যকে সাহায্য করার প্রশ্নই নেই।” |
(সহ প্রতিবেদন: রাজীবাক্ষ রক্ষিত) |