বছর নতুন, জয়জয়কার পুরনোরই
ভূতেরও ভবিষ্যৎ আছে। বাঙালির শুধু অতীত।
ফেলে আসা বছরের সারকথা এটাই।
রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি, খেলা থেকে সিনেমা নতুনের সন্ধানে হা পিত্যেশ করেই কেটে গেল ২০১৩। বিজ্ঞানে নতুন কাজের কয়েকটি ঝিলিক বাদ দিলে যা জেগে থাকে তার বেশিটাই অন্ধকার।
তবে বছরের প্রান্ত লগ্নে কিছুটা আশার আলো জ্বালিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চেনা মমতা নয়, তিনি ‘মমতা ২’। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে মমতা অনেক বেশি সাহসী, প্রশাসক হিসেবেও আগের চেয়ে দৃঢ়। অবশ্যই না-হওয়ার পাল্লা এখনও ভারী। করার আছে অনেক। তবু কিছুটা নাড়াচাড়ার ফলে ইতিবাচক সম্ভাবনার অঙ্কুর যে মাথা চাড়া দিচ্ছে, তা চোখ এড়ানোর নয়।
বছরের মধ্য ভাগে হওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজের রাজনৈতিক ভিত কতটা মজবুত, তা ফের যাচাই করে নিয়ে প্রায় বিরোধীহীন ময়দানে এই ‘অন্য’ মমতার আত্মপ্রকাশ। বছরের শেষ সপ্তাহে আচমকা মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল ঘটিয়ে যিনি বার্তা দিয়েছেন: কাজ চাই, নইলে সরতে হবে।
রাজ্য প্রশাসনের নতুন ঠিকানা নবান্ন।
কিন্তু শিল্পমন্ত্রিত্বে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় অমিত মিত্র এসেছেন বলেই রাজ্যে শিল্পের ভবিতব্য রাতারাতি বদলে যাবে, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। মুখ্যমন্ত্রীও জানেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের মূল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথে এখনও অনেক দূর যাওয়া বাকি। তবু বলতেই হবে, কলকাতা এবং দিল্লিতে এর আগের দু’টি শিল্পপতি-সম্মেলনের তুলনায় এ বছরের মুম্বই সম্মেলন উপস্থিতির নিরিখে ছিল অনেক বেশি বর্ণময়। দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা অনেকেই তাতে যোগ দেন। শিল্পের বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট একটি রাজ্যের পক্ষে এটা এখনই নস্যাৎ করা অনুচিত।
প্রশাসক হিসেবেও অন্য রকম মমতাকে চেনাল ২০১৩। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দার্জিলিং। পাহাড়ের গোর্খা নেতা বিমল গুরুঙ্গের আস্ফালনকে থোড়াই কেয়ার করে মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিঙে দাঁড়িয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলনের মোকাবিলা করেছেন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই গুরুঙ্গকে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ফিরতে বাধ্য করেছেন। শান্ত রয়েছে জঙ্গলমহলও। এ সবই তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয়।
বিবাদি বাগের মহাকরণ থেকে সরকারের সদর দফতর দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ও-পারে তুলে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও রয়েছে একই রকম দৃঢ়তা। দীর্ঘদিন ধরে মহাকরণ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেও মমতার পূর্বসূরি কোনও মুখ্যমন্ত্রী যে পদক্ষেপ করার হিম্মৎ দেখাতে পারেননি, মমতা অল্প দিনের নোটিসে সফল ভাবে তা করলেন। পাশাপাশি কড়া হাতে রাশ ধরলেন দলমত নির্বিশেষে সরকারি কর্মীদের ইউনিয়নবাজির।
তবে পুরোপুরি সরেনি ‘মমতা ১’-এর ছায়া। তাই সরকারি কর্মীদের ছুটির সংখ্যা নতুন বছরে কমার বদলে বেড়েছে। ছুটি কমিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ‘মমতা ২’ হয়ে উঠতে পারেননি। পারেননি তাঁর মন্ত্রিসভার কলেবর ছোট করতেও। সেখানেও সিপিএমের সরকারের মতো বারবার তাঁর পিছু টেনে ধরেছে মন্ত্রিত্বে ‘কোটা’ রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। তবু আড়াই বছর সরকার চালানোর পর কিছু পরিবর্তনের যে সদর্থক চেষ্টা মমতা শুরু করেছেন, তা ২০১৩ -র প্রাপ্তি।
বছরের প্রাপ্তির তালিকায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য কেমোমা-র সূচনা। বাংলার সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনাকে অর্থবহ করে নভেম্বরে শিলান্যাস হল কলকাতা মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট অর্থাৎ কেমোমা-র। আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক মানের হবে এই শিল্প-প্রদর্শশালা ও সংস্কৃতিকেন্দ্র। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “বিশ্বমানের শিল্পকলা চাক্ষুষ করতে এ দেশের মানুষকে আর প্যারিস-ভেনিস দৌড়তে হবে না।”
দেব ও বাঙালি গবেষক উপাসনা দাস।
উৎকর্ষের আর এক স্মারক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও বছর শেষে রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আশা জাগায়। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি উপাচার্য আনা হলে তাতে সরকার এবং আচার্য-রাজ্যপাল কারও দিক থেকেই কোনও নীতিগত আপত্তি নেই। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-রাজনীতি অবশ্য এখনও কলুষমুক্ত হয়নি। কলেজস্তরে তো বটেই, স্কুলেও রাজনৈতিক জুলুম ও অশান্তি এই বছরেও বহাল। এমনকী ছাত্র ইউনিয়নের ভোটকে রাজনীতির মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনও উদ্যোগ এখনও নেই। তবে তারই মধ্যে প্রেসিডেন্সির উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সরকারের খোলা মন শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অনিলায়নের’ বাধা কাটানোর শুভ ইঙ্গিত।
সিনেমা এবং নাটকের মতো মূল ধারার সংস্কৃতিতে কিন্তু উৎকর্ষের কোনও ছাপ রাখতে পারেনি এই বছরটি। সেখানে বরং অবনমনের ছায়াপাত। যদিও বাংলা সিনেমা এবং বাংলা নাটকে টাকা ঢুকছে বিস্তর। তবে ‘মানি’র সঙ্গে মান বাড়ছে না।
তাই কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ঠেলে ১৫ কোটি টাকায় তৈরি ‘চাঁদের পাহাড়’-এর চূড়ায় পৌঁছতে পেরেছেন এ কথা বলা যায় না। তেমনই প্রদীপের আশ্চর্য শক্তি সিনেমায় লগ্নিকারীদের খুশি করতে পারে, কিন্তু পরিচালক অনীক দত্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় থেকেই গেল। বাংলায় চলচ্চিত্রে আজকের অবিসংবাদী প্রতিভা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ও সেই প্রদীপের আলোয় বেশ অনুজ্জ্বল। আরও ভাবার বিষয়, টলিউডের পর্দায় কোনও নতুন মুখ উঠে আসছে না। দেবের মতো নায়ক, শাশ্বতের মতো অভিনেতা তবু আছেন। নায়িকার বাজারে পূর্ণ অমাবস্যা!
নাট্যমঞ্চেও একই হাল। টাকা আছে, কিন্তু প্রতিভা?
নব্বইয়ের দশকে ব্রাত্য-সুমন-দেবশঙ্কর-সোহিনীদের উত্থান। আজও বাংলার নাটকে তাঁরাই তারা। গত এক দশকের মধ্যে বলার মতো নতুন নাম একটিই, অনির্বাণ ভট্টাচার্য। তিন বছর আগে ২০১০-এ সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘রাজা লিয়ার’, তার পরে ‘দেবী সর্পমস্তা’ তাঁর জাত চিনিয়েছে। বাকিটা এখনও আঁধার। কেন এই হাল? ব্রাত্য বসুর মন্তব্য: “পুরনো চালই ভাতে বাড়ছে!” তাই কি দর্শক টেনেছে ‘সিনেমার মতো’! তবে শহরে এই বছরেই তুলনায় কম নামী আর একটি দলের নাটকের টিকিট বিক্রি হয়েছে এক হাজার এবং পাঁচশো টাকায়, তাতেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। আশার পাদপ্রদীপে হয়তো এটুকুই আলো। এই নাট্যগোষ্ঠীই আবার শেক্সপিয়রের ওথেলোকে বিবস্ত্র করে মঞ্চে নামিয়ে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছে। পুরুষের নগ্নতা! এ-ও কি কোনও পরিবর্তন! তর্ক উসকে দিল ২০১৩।
সঙ্গীতে এ বছরের নজরকাড়া নাম মুর্শিদাবাদের তরুণ অরিজিৎ সিংহ। আনকোরা নতুন মুখ না হলেও বলিউড এবং টলিউডে গায়ক হিসেবে তাঁর অবস্থান ২০১৩-তে আরও মজবুত। প্রীতম চক্রবর্তী, বিশাল ভরদ্বাজ, সঞ্জয় লীলা বনশালি থেকে শুরু করে জিৎ গাঙ্গুলি, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত সবাই এখন অরিজিৎকে চান।
সাহিত্যে কিন্তু মনোযোগ কাড়ার মতো নতুন কোনও কলম এ বছরেও উঠে এল না। কি ইংরেজি কি বাংলা, বাঙালির এ বারেও খরা। তবে সুখের কথা, আত্মজীবনী লেখার প্রবণতা বাড়ছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পরে সুবোধ সেনগুপ্ত, তপন রায়চৌধুরী, দুই অশোক মিত্র লিখেছেন আগেই। এ বছর অর্থনীতির অনাবাসী মাস্টারমশাই প্রণব বর্ধন লিখলেন ‘স্মৃতিকণ্ডূয়ন’।
স্মৃতি থেকে ভবিষ্যৎ। ভরসা দিচ্ছেন তরুণ বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানে নানা মাপের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন যাঁরা, তাঁঁদের অনেকেরই ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতায়। যেমন ইলাহাবাদের হরিশ্চন্দ্র রির্সাচ ইন্সটিটিউটের গবেষক রাজেশ গোপকুমার। বিষয়, মাধ্যাকর্ষণ। পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের তিন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন ব্রহ্মাণ্ড সব দিক থেকে আকারে এক রকম নয়। এঁদের দু’জন বিশুদ্ধ বঙ্গসন্তান তরুণ সৌরদীপ ও সন্দীপ মিত্র। বছরের গোড়ায় বিতর্ক তুলে দেন আরও দুই বাঙালি গবেষক উপাসনা দাস ও বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়। অন্যতর হিসেব দিয়ে তাঁদের দাবি, ব্ল্যাক হোল নিয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যমের তত্ত্ব শেষ কথা বলে না। গণিতেও নতুন গবেষণার দরজা খুলেছেন কলকাতার আইএসআই এবং মুম্বইয়ের টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের নীনা গুপ্ত। তাঁর বক্তব্য: বীজগণিত ও জ্যামিতি যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে একটি অনুমানকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া ভুল।
পড়া ছেড়ে খেলার মাঠ। ক্রিকেটে এ বছরের নতুন তারা মহম্মদ শামি। উত্তরপ্রদেশে জন্ম হলেও বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলে শামি ভারতীয় দলে ঢোকেন এই বছর। অভিষেকেই ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে ন’টি উইকেট। সৌরভের উত্তরসূরি হয়ে ওঠেন কি না, বাঙালির চোখ থাকবে সেই দিকে। ফুটবলে সেই চিরাচরিত মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। তাতে উত্তরণ বা নতুনত্ব কোনওটাই নেই। আন্তর্জাতিক খেলার আসরে বাঙালির নাম একটিই, এবং তিনিও পুরনো লিয়েন্ডার পেজ। রাদেক স্টেপানেককে সঙ্গী করে এই বছর টেনিসে ইউ এস ওপেনে ডাবলস খেতাব জিতে নিয়েছেন তিনি।
একচল্লিশ বছরের যুবকের এই কৃতিত্ব বুঝিয়ে দেয়, বাঙালির ‘অতীত’ আছে। স্বাগত ২০১৪।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.