দাওয়ায় গোলা বানিয়েই পেঁয়াজ চাষে বাড়তি চাড়, ফল হাতেনাতে
ছর চারেক আগে পেঁয়াজ ফলিয়ে বিস্তর গুণাগার দেওয়ার পরে আর ও পথ মাড়াননি বলাগড়ের সমীর দলুই। আলু চাষেই লগ্নি করেছিলেন জমানো পুঁজি। কিন্তু এখন আবার তিনি আলু ছেড়ে পেঁয়াজে মন দিয়েছেন।
এবং ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। কী ভাবে?
সমীরবাবুর ব্যাখ্যা: এঁটেল মাটিতে পেঁয়াজের চাষ ভাল হয়। এ রাজ্যে তার অভাব নেই, উপরন্তু আবহাওয়া অনুকূল। অথচ মজুতের তেমন সুযোগ না-থাকায় তাঁর মতো বহু চাষি পেঁয়াজ ছেড়ে অন্য চাষে ঝুঁকেছিলেন। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে, সরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু গোলা তৈরি হয়েছে বলাগড়ে। পরীক্ষামূলক ভাবে সেখানে পেঁয়াজ রেখেই তিনি লাভবান হয়েছেন বলে দাবি হুগলির ওই কৃষকের। “গত বছরের ফলন এখনও আমার গোলায় রয়ে গিয়েছে।” জানাচ্ছেন তিনি।
শুধু সমীর দলুই নন। ফি বছর পেঁয়াজের আকালে নাজেহাল হওয়া বঙ্গবাসীর অন্যতম ভরসা হয়ে উঠতে পারে এই পেঁয়াজ-গোলা। অন্তত সরকারি কৃষি-কর্তাদের তেমনই আশা। তাই এখন পেঁয়াজ-গোলা বানানোর জন্য কৃষকদের ভর্তুকিও দেবে রাজ্য সরকার, যাতে ওঁরা পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। কর্তাদের বক্তব্য: মূলত সংরক্ষণের ঘাটতিতেই যে পশ্চিমবঙ্গে পেঁয়াজ চাষ মার খাচ্ছে, কৃষি বিপণন আধিকারিকেরা বিভিন্ন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়কে বারবার তা বুঝিয়েছেন। ওঁদের হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গে বছরে ৬-৮ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ লাগে, যার সিংহভাগ আসে মহারাষ্ট্র থেকে। রাজ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে টেনেটুনে লাখ দেড় টনের মতো পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। ওই সামান্য ফলনও ঠিকঠাক সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। অক্টোবরের খরিফ পেঁয়াজ হোক, বা ফেব্রুয়ারির রবি কোনওটাই এক মাসের বেশি মজুত রাখার পরিকাঠামো নেই।

গোলায় মজুত পেঁয়াজ।—নিজস্ব চিত্র।
কাজেই মহারাষ্ট্রের সরবরাহে টান পড়লেই পশ্চিমবঙ্গে হাহাকার। এমতাবস্থায় প্রাথমিক ভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন কৃষি-কর্তারা। তাঁরা ছোট ছোট ‘মডেল’ বানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখিয়েছিলেন, একেবারে সাবেকি গোলাতেও কী ভাবে মাসের পর মাস পেঁয়াজ মজুত রাখা যায়। যুক্তি দিয়েছিলেন, সংরক্ষণের সুবিধা বাড়লে চাষও বাড়তে বাধ্য। নবান্ন-সূত্রের খবর: তার পরেই এ নিয়ে উঠে-পড়ে লাগতে কৃষি ও কৃষি বিপণন দফতরকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। দুই দফতরের অফিসারদের ডেকে মমতা বলেন, মহারাষ্ট্র একচেটিয়া পেঁয়াজের ব্যবসা করছে। অন্য রাজ্যের স্বার্থ না-দেখে যখন-তখন পেঁয়াজ পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে। তার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অতএব, পেঁয়াজ জোগানে ‘মহারাষ্ট্র-নির্ভরতা’ কমানোর পথ খুঁজতে হবে। নিজস্ব ফলন যত কমই হোক, বাড়াতে হবে সংরক্ষণের মেয়াদ।
সেই নির্দেশ মেনে নদিয়া-হুগলি-বর্ধমান-পুরুলিয়ার মতো যে সব জেলায় তুলনায় পেঁয়াজের চাষ বেশি, সেখানে গোলা নির্মাণে উদ্যোগী হয় কৃষি বিপণন দফতর। দফতরের এক কর্তার কথায়, “বছরখানেক আগে পরীক্ষামূলক ভাবে ষাটটি গোলা বানিয়ে পেঁয়াজ রাখা হয়েছিল। দেখা গেল, তেরো-চোদ্দো মাসেও পচন ধরেনি!”
ওখানে পেঁয়াজ মজুত করা হয়েছিল কী ভাবে?
কৃষি-কর্তাটি বলেন, “গোলার মধ্যে বেশ কিছু কাঁচা বাঁশ সোজা ভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে তাতে লিচুর মতো পেঁয়াজ ঝুলিয়ে রাখা হয়। ইটের দেওয়ালে এমন ভাবে ফাঁক রাখা হয়েছে, যাতে বাতাস ঢুকতে পারে। তাতে গোলার ভিতরে আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকে মোটামুটি ৭০%।”
এ হেন পদ্ধতিতেই বছর-পুরনো পেঁয়াজকে দিব্যি সতেজ রাখা গিয়েছে বলে কর্তাদের দাবি। আর তাঁদের দেখানো পথে হেঁটে কার্যত দিন ফিরে গিয়েছে বলাগড়ের সমীর দলুইয়ের মতো আরও অনেকের। যেমন, বাঁকুড়ার সোনামুখীর চঞ্চল পাল। যিনি বলছেন, “আগে কখনও পেঁয়াজ ফলিয়ে তেমন লাভ করতে পারিনি। বেশি দিন মজুত রাখার সুযোগ না-থাকায় গত বছরেও পাইকারি বাজারে আট টাকা কিলোয় বেচতে হয়েছে। কিন্তু এ বার দর পেয়েছি পঁয়তাল্লিশ টাকা!” কী ভাবে পেলেন?
চঞ্চলবাবু জানাচ্ছেন, কৃষি বিপণন দফতর তাঁর বাড়ির দাওয়ায় ছোটখাটো পেঁয়াজ-গোলা বানিয়ে দিয়েছে। বছরখানেক ধরে তিনি সেখানে ফসল মজুত রাখতে পারছেন। পাইকারি বাজারে যখন-যেমন দাম উঠেছে, তখন-তেমন বেচতেও পারছেন। ফলে লাভের কড়ি উঠছে ঘরে। তাই গত বছর যেখানে সাকুল্যে আঠারো কাঠায় পেঁয়াজ বুনেছিলেন, এ বার সেখানে পেঁয়াজের জন্য পঁচিশ কাঠা জমি এখনই তৈরি করে ফেলেছেন মেরাশোল গ্রামের ওই কৃষক।
উৎসাহিত সরকারও। কৃষি-কর্তাদের আশা, এ ভাবে সংরক্ষণের সুযোগ বাড়লে সমীরবাবু-চঞ্চলবাবুর মতো বহু চাষি-ই পেঁয়াজ চাষে লগ্নি করতে এগিয়ে আসবেন। তাতে পশ্চিমবঙ্গে পেঁয়াজের ফলন বাড়বে, রাজ্যবাসীর চাহিদা সামাল দিতে ভিন রাজ্যের ভরসায় অতটা থাকতে হবে না। এই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে পেঁয়াজ-গোলা তৈরির জন্য চাষিদের ভর্তুকিদানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। “কুড়ি ফুট বাই বারো ফুটের একটা পেঁয়াজ-গোলা বানাতে ত্রিশ-বত্রিশ হাজার টাকা খরচ পড়ে। কেউ গোলা বানাতে চাইলে পঁচিশ হাজার পাবেন ভর্তুকি হিসেবে।” বলেছেন রাজ্যের কৃষি বিপণন-সচিব সুব্রত বিশ্বাস।
সম্প্রতি এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশও বেরিয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন সচিব।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.