পাক্কা পনেরো বছরের একটা প্রতীক্ষার অবসান ঘটলে ঠিক কেমন লাগে?
মিঠে ওম ছড়ানো ডিসেম্বরের রোদ্দুর মাখা রবিবাসরীয় দুপুরে যাঁর জীবনে সেটা ঘটল, তিনি নিজে বলছেন, “অসাধারণ!” সদ্য ম্যাকলিয়ড রাসেল ট্যুর চ্যাম্পিয়নশিপ বিজয়ী এর সঙ্গেই যোগ করলেন, “বড্ড লম্বা অপেক্ষা করতে হল। কিন্তু অনুভূতিটা দারুণ সুখের। বলতে পারেন এটা আমার সত্যিকারের ঘরে ফেরা। গুড হোম কামিং!”
বলার সময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিতে কলকাতায় নিজের প্রথম খেতাব জেতার একটা দারুণ তৃপ্তি অনির্বাণ লাহিড়ীর।
কলকাতা-বিজয় পর্ব সাঙ্গ করে এ বার যিনি মন দিচ্ছেন অপরিচিত কোর্সে জীবনের সবথেকে লম্বা রাউন্ড খেলায়। আগামী ৫ জানুয়ারি, বাগদান পর্বটা সেরে ফেলছেন ভারতের ‘মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর’! পাত্রী পুণের মেয়ে ইপশা জামওয়াল।
বাঙালি হলেও অনির্বাণ মোটেই কলকাতার নন, শনিবারই এই দাবি করেছিলেন ভারতীয় গল্ফ ট্যুরের এক কর্মকর্তা। বেঙ্গালুরুর বছর ছাব্বিশের তারকা নিজে কিন্তু এ দিন ঘোরতর প্রতিবাদ করে বললেন, “আমি তো প্রায়ই কলকাতায় আসি। এখানে আমার দাদু-দিদা থাকেন। আমি পোস্তও ভালবাসি। হ্যাঁ, আজকাল খেলার ফাঁকে সময় বের করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। কিন্তু কলকাতাও আমার শহর। এই ট্রফিটাও সল্টলেকে দাদু-দিদার বাড়িতে রাখব বলেই ঠিক করেছি।” |
আরসিজিসি-র কোর্সে অনির্বাণ প্রথম নেমেছিলেন এগারো বছর বয়সে। অবশেষে এতদিনে চ্যাম্পিয়ন। চার শটে প্রিয় বন্ধু, কলকাতার তারকা রাহিল গাঙ্গজিকে হারিয়ে ট্রফি আর ২১ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকার বিজয়ীর চেক হাতে অনির্বাণ বলছিলেন, “আরসিজিসি-তে এটাই আমার সেরা পারফরম্যান্স। এখানে এত ভাল আগে কখনও খেলিনি।”
এ মরসুমে ভারতীয় ট্যুরে চার টুর্নামেন্টে নেমে তিনটি জিতেছেন। এশীয় ট্যুরে জেতেন সেল-এসবিআই ওপেন। আরও দু’টি টুর্নামেন্টে রানার্স। খেলেছেন গল্ফ বিশ্বকাপ। বিশ্বের ১১ নম্বর অনির্বাণ বলছিলেন, “এটাই আমার সেরা মরসুম। অগস্টে হাঁটুর চোটটা একটু ভোগায়। কিন্তু তার পর থেকে একদম ঠিক দিকে এগোচ্ছি, খেলায় যে উন্নতিটা চেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে। পারফরম্যান্সের মান অন্তত এক ধাপ উপরে নিয়ে যেতে পেরেছি।” এই পারাটার জন্য ফিটনেস নিয়ে খাটার পাশাপাশি মানসিক শক্তি বাড়াতে ধ্যান করেনগৌতম বুদ্ধ আবিষ্কৃত বিপাসনা পদ্ধতিতে। জানালেন, ধ্যান দারুণ সাহায্য করছে।
বাকি গল্ফারদের মতোই অনির্বাণও ঢালাও শংসাপত্র দিয়ে গেলেন আরসিজিসি-র কোর্সকে। বলে দিলেন, “কলকাতায় এ বার এত বৃষ্টি হয়েছে। তা সত্ত্বেও কোর্সটা এমন সুন্দর অবস্থায় যে বিদেশের যে কোনও কোর্সের সঙ্গে টক্কর দেবে।”
সেই পান্না-সবুজ কোর্সে এ দিন ৬৯ করে ১৭-আন্ডার ২৭১ মোট স্কোরে শেষ করলেন। তবে সকালে অনির্বাণের শুরুটা মোটেই আদর্শ ছিল না। দ্বিতীয় হোল-ই ডাবল বোগি করে বসেন। অন্য দিকে, রাহিল আর শনিবার ৬৫ স্কোর করা চিরাগ কুমার দারুণ শুরুতে তখন চাপ তৈরি করছেন। অনির্বাণও স্বীকার করলেন, “শুরুটা টেরিবল হয়। কিন্তু রাহিল আর চিরাগের চাপটাই আমাকে তাতিয়ে দিল। সতেরো নম্বর পর্যন্ত চাপটা ছিল। শেষ হোল-এ অবশ্য বুঝে যাই ট্রফি আমার।” সম্ভবত সে জন্যই ৬টি বার্ডির পর আঠারো নম্বর হোলটা বোগি করে বসেন। তবে শেষ শটটা মেরেই বল ছুড়ে দিলেন কোর্স ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা খুদে উৎসাহীদের একটা ভিড়ের দিকে। পরে দেদার অটোগ্রাফও বিলোলেন হাসিমুখে।
খালি একটাই আফসোস। এই প্রথম অনির্বাণ কলকাতায় আর তাঁর দাদু-দিদা হায়দরাবাদে। সেখান থেকেই পুণে চলে যাবেন অনির্বাণের এনগেজমেন্ট-এ যোগ দিতে। ফলে এ বারটা বন্ধু রাহিলের বাড়িতেই ছিলেন। ১৩-আন্ডার ২৭৫ স্কোরে রবিবারের রানার্স রাহিল ফাঁস করে দিলেন অনির্বাণের শনিবারের পৈটিক-বিভ্রাটের রহস্য। হেসে বললেন, “প্রচুর চিকেন রেজালার সঙ্গে অনেক ক’টা পরোটা সাবাড় করলে এমন একটু-আধটু তো হবেই!”
মরসুমে ইতি টানার আগে সপ্তাহ দুইয়ের ছুটি কাটিয়ে অনির্বাণ-রাহিলরা তাইল্যান্ডে নামবেন শেষ টুর্নামেন্টে। তার পরে অনির্বাণের তালিকায় আগামী বছরের ইউরেশিয়া কাপ। যাকে এশীয়, বিশেষ করে ভারতীয় গল্ফারদের বিশ্বের দরবারে নিজেদের প্রমাণ করার অন্যতম বড় মঞ্চ বললেন দু’জনেই। “এ ছাড়াও ইউরোপ, জাপান বা পিজিএ ট্যুরে নামার কার্ড জেতার চেষ্টা প্রধান লক্ষ্য। আর অবশ্যই স্বপ্ন জীবনে একটা মেজর জেতা,” বলছিলেন অনির্বাণ।
এই মুহূর্তে অবশ্য নিজের ‘প্রথম প্রেম’ গল্ফ নয়, অনির্বাণের হৃদয়-মন জুড়ে তাঁর ‘নতুন কেরিয়ার’। রাহিল বলছিলেন, “ইপশা ছোট্টখাট্ট, অসম্ভব ফুর্তিবাজ, অফুরন্ত এনার্জির দারুণ মজাদার মেয়ে। জানেন, নিজের চাকরি-টাকরি ছেড়ে দিয়ে কুকুরদের ট্রেনার হওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ঘুম কাতুরে অনির্বাণকে ওর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য বেস্ট অব লাক!” অনির্বাণকে সে কথা বলতেই লাজুক হাসি ফুটল। বললেন, “জীবনে এই মুহূর্তটা তো এক বারই আসে। বলতে পারেন আমার জন্য এটা একটা নতুন অভিযান, নিউ জার্নি, নিউ কেরিয়ার। এত দিন জীবনটা শুধুু গল্ফ কোর্স ছিল। এ বার কোর্সের বাইরের জীবনটাকে চিনতে শিখব।”
রবিবার সন্ধ্যাতেই বেঙ্গালুরু ফেরার ফ্লাইট। কলকাতায় ‘হোম কামিং’ সেরে, নতুন জীবনের উড়ান ধরার তাড়ায় রওনা দিলেন অনির্বাণ। |