|
|
|
|
ট্র্যাজিক নায়িকার এখনও আশা, আবার ফিরবেন
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
ক’দিন আগেও মতিলাল নেহরু মার্গের এই বাড়িটিতে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা ছিল। এখন অপরাহ্নে ভিন্ন দৃশ্যপট। পড়ন্ত মিঠে রোদ্দুর। সবুজ লনে বেতের চেয়ারে বসে আছেন তিনি। পঁচাত্তর বছর বয়সী দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেসের দিল্লির মুখ শীলা দীক্ষিত। ভিড় নেই। পাঁচিলের ধার দিয়ে দূরে একটা ময়ূরকে হেঁটে যেতে দেখলাম। প্রশ্ন করলাম, গত কাল আর আজ, কত ফারাক? অতীত আর বর্তমানের এই অসাম্যে কী অনুভূতি?
চুল ডাই করেন না। কাঁচাপাকা চুল। চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “কেন ফারাক হবে! সে দিনও তুমি এসেছিলে। আজও এসেছো। জীবন তো একই ভাবে চলছে।”
ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত, এতে তো কোনও সন্দেহ নেই। এ ভাবে ধূমকেতুর মতো উঠে আসা এক অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে পরাস্ত করে সটান দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে গিয়ে বসবেন, এমনটা তো ছিল স্বপ্নেরও অতীত। গলায় ক্লান্তি আছে, সতীর্থ বহু কংগ্রেস নেতার প্রতি অভিমান আছে। তবু শীলা এখন বিরোধী রাজনীতি করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত। অবসর নিয়ে পুত্র সন্দীপকে দায়িত্ব দিয়ে বাণপ্রস্থে যেতে এখনই রাজি নন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “রাজনীতিতে তো জয়-পরাজয় থাকেই। |
|
ইন্দিরা গাঁধীও নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। আমি বলি, রাজনীতিতে কভি খুশি, কভি গম। তা বলে রাজনীতির প্রক্রিয়াটা থেমে যাবে, এমন তো নয়। ক্ষমতায় থাকার সময় প্রশাসনিকতার রাজনীতি করছি। এখন বিরোধী দলের রাজনীতি করব।”
শীলা আদতে পঞ্জাবি। বিয়ে করেছিলেন কংগ্রেস নেতা উমাশঙ্কর দীক্ষিতের ছেলে, আইএএস অফিসার বিনোদ দীক্ষিতকে। জন্মেছিলেন পঞ্জাবের কপূরথালায়। ক্ষত্রিয় পরিবারের গ্রামের মেয়ে পড়াশোনা করেছিলেন দিল্লির কনভেন্ট অব জেসাস অ্যান্ড মেরি স্কুলে। তার পর মিরান্ডা হাউস কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। স্বামী প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবসাদের সময়টায় পাশে সব সময় থেকেছেন সক্রিয় রাজনীতি করা পুত্র সন্দীপ দীক্ষিত এবং মেয়ে লতিকা সঈদ। আর আছে সঙ্গে নাতি-নাতনি।
এ বারের নির্বাচনে যে নির্ভয়ার গণধর্ষণ থেকে শুরু করে কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতির মতো বেশ কিছু বিষয় তাঁর বিপক্ষে গিয়ে থাকতে পারে, সে কথা অস্বীকার করছেন না শীলা। কিন্তু দলের বেশ কিছু নেতার নেতিবাচক ভূমিকাও যে দায়ী, তা-ও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেকে এই মুখ্যমন্ত্রী নিবাস এখনই ছাড়তে বারণ করেছিলেন তাঁকে। কিন্তু শীলা এখনই বাড়িটা ছেড়ে দিতে চান। বাক্সপ্যাঁটরা বাঁধা শুরু হয়ে গিয়েছে। শুনলাম, দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাবেন বলে মনস্থ করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কেজরিওয়াল তো মুখ্যমন্ত্রী নিবাসে থাকবেন না বলে জানিয়েছেন। তা হলে আপনার এত তাড়াহুড়ো করার কী আছে? শীলার জবাব, “উনি থাকবেন কি থাকবেন না, সেটা ওঁর ব্যাপার। কিন্তু আমি এ বাড়িতে থাকার অধিকার হারিয়েছি। তাই আমি আর থাকব না।”
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাড়ি ছাড়ার কথা বললেও কংগ্রেস রাজনীতিতে কিন্তু একটা জিনিস খুবই স্পষ্ট। তা হল, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয় সত্ত্বেও দিল্লিতে শীলাই এখনও কংগ্রেসের মুখ। অথচ রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে ভরাডুবির পর সে সব রাজ্যে নতুন নেতাদের দায়িত্বে আনা হচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু শীলা। কারণ হাইকম্যান্ড মনে করছে, দেড় দশক আগে শীলাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করাটা যে ভুল ছিল না, সেটা তাঁর দীর্ঘ রাজত্বেই স্পষ্ট। এই ভোটে নির্ভয়া-কাণ্ড, কমনওয়েলথ দুর্নীতি বা সার্বিক ভাবে মনমোহন জমানার বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভ শীলার সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা চিরস্থায়ী হবে না বলেই বিশ্বাস করেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। সেটা আরও স্পষ্ট দিল্লির কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্বটা শীলা-বিরোধী অজয় মাকেনকে না দিয়ে অরবিন্দর সিংহ লাভলিকে দেওয়া। যিনি মাকেন-বিরোধী যেমন নন, তেমন শীলা-বিরোধীও নন। আর তাই হেরেও গিয়েও রাজধানীর রাজনীতিতে শীলা আজও প্রাসঙ্গিক।
অথচ এই মানুষটিরই বাড়িতে হঠাৎ করে গিয়ে পড়লে মনে হবে, যেন আমাদেরই ঘরের কোনও মাসিমা বা পিসিমা। সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরতে ভালবাসেন। হঠাৎ হাতে অনেক সময় এসে গিয়েছে। এখন তাই কিছু দিনের জন্য রাজনীতির কচকচি থেকে সরে এসে দু’টি কাজ মন দিয়ে করছেন। একটি হল রান্না। আর অন্যটি গান শোনা। আজ যেমন নিজে নিজেই মাশরুম, মুরগি ও আনারস দিয়ে এক নতুন ধরনের রেসিপি তৈরি করে ফেলেছেন। নিজের পরিমিত আহার। কিন্তু নাতি-নাতনি, পুত্রবধূ, জামাই এঁদের খাইয়ে সুখ পান। বর্ষবরণের মরসুমে সান্ধ্য আড্ডাতেও খামতি নেই। শুনতে ভালবাসেন পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত। বিটোভেন থেকে জ্যাজ, সবই শোনেন। আসলে দীর্ঘদিনের অভ্যেস। বললেন, “আগে যখন স্বামী ছিলেন, তখন দু’জনে একসঙ্গে শুনতাম। এখন রাতে যখন একা হয়ে যাই, তখন বই পড়তে পড়তে শুনি।” বাড়ির সব ঘরেই থরে থরে সাজানো নানা ধরনের বই। অমর্ত্য সেন থেকে ওরহান পামুক, সব পাবেন সেখানে। এখন পড়ছেন ২৬/১১-র মুম্বই-হামলার উপরে আদ্রিয়ান লেভি ও ক্যাথি স্কট-ক্লার্কের লেখা সাম্প্রতিক বই, ‘দ্য সিজ’।
তবে শীলা যে সারাক্ষণ বাড়িতেই কাটাচ্ছেন, তা নয়। এই তো সে দিন জনসংযোগ গুরু দিলীপ চেরিয়ানের বড়দিনের পার্টিতে হাজির হয়েছিলেন। আবার নিজের নির্বাচন কেন্দ্রের সাধারণ মানুষদের বিয়ের নেমন্তন্ন রাখতেও তিনি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত নন। বিষণ্ণতা আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনায় আশাবাদী তিনি। একদা উত্তরপ্রদেশের একটা খুব কঠিন নির্বাচনী কেন্দ্র কনৌজ থেকে জিতেছিলেন। রাজীব গাঁধীর আমলে দীর্ঘদিন কেন্দ্রে মন্ত্রীও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পার্থক্য শুধু, সে দিন চুলে পাক ধরেনি। আজ ধরেছে। আর তাই তিনি এখন উত্তেজিত নন। অস্থির নন। বরং তিনি বলেন, “রাজনীতিতে পূর্ণচ্ছেদ নেই। মানুষের রাগ হয়েছিল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলাম। অনেক ভুলও করেছি। ভুল শুধরে আবার এগোব। আশা করব, মানুষ আমাদের ক্ষমা করবে।” তিন নম্বর মতিলাল নেহরু মার্গের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এত কিছুর পরেও এই বৃদ্ধার মুডটা কিন্তু মনে হল ‘আবার আসিব ফিরে’! |
|
|
|
|
|