বছর শেষ হল বলে। এ দিকে, হাড় কাঁপানো হাওয়া আর কনকনে ঠান্ডার মোচড়টাই নেই। কিন্তু আমুদে বাঙালিকে দমিয়ে রাখে কার সাধ্য? দুর্গাপুজোয় লাগাতার বৃষ্টিও যাঁদের হার মানাতে পারে না, সেই বাঙালির কাছে বর্ষশেষে কী বা গরম, কী বা শীত! ফলে দস্তুরমতো জ্যাকেট, সোয়েটার, রকমারি শীতপোশাক গায়ে চাপিয়ে বছরের শেষ রবিবারটা চুটিয়ে উপভোগ করেছে শহর। ময়দান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, চিড়িয়াখানা থেকে তারামণ্ডল ঢল নেমেছে সর্বত্রই। শীতের শহরে জমজমাট সার্কাসও। ছুটির দুপুর থেকে রাত সেখানেও ভিড়টা ছিল চোখে পড়ার মতো।
শুধু ভিড়ই নয়, যেন রীতিমতো পিকনিক! বাড়ি থেকে খাবার রেঁধে এনে মিঠে রোদে শতরঞ্চি, চাদর বিছিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়া, ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট কিংবা ব্যাট-বল নিয়ে ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠা। কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এটাই রবিবারের ছবি। |
উৎসবের মরসুমে আমুদে শহর। রবিবার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে। ছবি: সুমন বল্লভ। |
তবে এ দিন শুধু শহর, শহরতলির মানুষ নন। এসেছেন আশপাশের জেলার, এমনকী ভিন্ রাজ্যের মানুষও। যেমন, উদয়পুরের হাজরা জুবেরি। দু’মাসের ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় দাদার বাড়িতে এসেছেন বছর শেষের পাঁচটা দিন কাটাতে। রবিবার খুদে আরিয়ানকে কোলে নিয়ে দাদা, বৌদির সঙ্গে হাজির ভিক্টোরিয়ায়। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ভিক্টোরিয়ার ভিতরে ঢুকে মন দিয়ে ঘুরে দেখলেন। দেওরের কলকাতায় আসার মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখতে ভিক্টোরিয়ার গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে ট্যাবে ছবি তুললেন বৌদি তরন্নুম জাফরি। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে হাজরা জানালেন, এর আগে কলকাতায় আসেননি ঠিকই, তবে ভিক্টোরিয়ার সৌন্দর্যের কথা শুনেছিলেন। এ দিনের ঘোরার তালিকায় তাই প্রথমেই ভিক্টোরিয়া দর্শন। এর পর যাবেন বিড়লা তারামণ্ডলে।
শুধু হাজরা বা তরন্নুম নন। দুই ছেলে সাত্যকি, সপ্তর্ষিকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া আর ময়দানে পিকনিক করতে হাজির মা সহেলি ঘোষও। ভিক্টোরিয়া অবশ্য উপলক্ষ মাত্র। সাত্যকি আর সপ্তর্ষি বিভোর রইল ব্যাডমিন্টনেই!
ময়দানের চেহারাটাও দিনভর সমান রঙিন। কেউ ঘোড়ায় চেপে ঘুরছেন। কেউ ক্রিকেট, কেউ ব্যাডমিন্টনে মত্ত। অনেকে শতরঞ্চি বিছিয়ে হাল্কা রোদে বসে উপভোগ করেছেন চারপাশের হুল্লোড়। খেলাধুলোর পাশাপাশি পেটপুজোও চলেছে সমানতালে। অনেকেই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন। কেউ লুচি-তরকারি তো কেউ পোলাও-মাংস। ময়দানে ঘাসের উপর চাদর বিছিয়ে হাতে হাতে প্লেট। জমে গিয়েছে দুপুরের খাওয়া।
ভিড় উপচে পড়েছে মিলেনিয়াম পার্ক, চিড়িয়াখানা, বিড়লা তারামণ্ডলেও। শেওড়াফুলি থেকে পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন বাবলু সিংহ। মিলেনিয়াম পার্কের আগে চিড়িয়াখানায় ঘুরে এসেছেন। প্রবল ভিড়ের চাপে সেখানে ঘোরা হলেও খাওয়া-দাওয়া হয়নি। মিলেনিয়াম পার্কে একটু ফাঁকা জায়গা জুটতেই সেরে নিলেন দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললেন।
ছেলে অভ্রর বায়না, ‘জয় রাইড’ চড়বে। একটু পরে সেটার জন্যও লাইনে দাঁড়ালেন বাবলুবাবু। নাগরদোলা আর জয় রাইডের সামনে তখন রীতিমতো ভিড়।
বছরের শেষ রবিবারে সবচেয়ে বেশি ভিড় টেনেছে চিড়িয়াখানা। সকাল থেকেই লম্বা লাইন। শিম্পাঞ্জি, বাঘ, হাতির খাঁচার সামনে ভিড় ছিল সব থেকে বেশি। বাচ্চা থেকে বুড়ো শিম্পাঞ্জির কাণ্ড কারখানা দেখে সকলের মুখেই হাসি। আর ভিড় টেনেছে সার্কাস। পার্ক সার্কাস ময়দানই হোক, দক্ষিণের পাটুলি কিংবা উত্তরে সিঁথি কেউ কচিকাঁচাদের হাত ধরে, কেউ বা স্রেফ ছোটবেলার নস্টালজিয়ার টানে, দুপুর থেকে রাত দলে দলে হাজির হয়েছেন মানুষ। না-ই বা থাকল বাঘ-সিংহ, হাতি, কুকুর, পাখি, জাগলিং, ব্যালেন্সের কেরামতি, মোটরবাইক বা ট্র্যাপিজের খেলাও কম কীসে! |