|
|
|
|
এক অভিনেত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী...একটি হত্যা
শহরের চার দিকে এখন এই নাটকের হোর্ডিং। কিন্তু কী আছে সে নাটকে?
কেন তা নিয়ে এত বিতর্ক? খোঁজ নিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত। |
চরিত্রের নাম মিসেস দাস। রঞ্জাবতী দাস।
ছোটবেলা কেটেছিল হাওড়াতে।
টেলিভিশনের এক প্রসিদ্ধ পরিচালকের সঙ্গে তার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সম্পর্ক তৈরি হয়।
এই সম্পর্কের জেরে তার পুরনো প্রেমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র, আত্মহত্যা করে। লিখে যায় এক সুইসাইড নোট। যেখানে স্পষ্ট লেখা থাকে এই চরিত্রের নাম।
তবে পরিচালকের সঙ্গেও তার বিয়ে টেকেনি। হায়দরাবাদ, মুম্বইয়ে শু্যটিং করার তাগিদে পরিচালক প্রায়ই কলকাতার বাইরে থাকে। সেই সময় অভিনেত্রীর জীবনে চলে আসে আর এক পুরুষ।
এক প্রসিদ্ধ নাট্যদলের কর্মী সে। বাড়ি হুগলি জেলায়। স্বামীর অবর্তমানে এই চরিত্র তাকে নিজের বাড়িতে থাকতে দেয়।
শুরু হয় সম্পর্ক।
স্বামী ফিরে এলে এই নিয়ে শুরু হয় অশান্তি। শেষে ডিভোর্স।
তবে নাট্যকর্মীর সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্কটাও টেকেনি। সত্যিকারের ভালবাসা থাকলেও, তত দিনে চরিত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে অন্য এক পুরুষের দিকে ঠেলে দেয়।
চতুর্থ এই পুরুষ এক রাজনৈতিক নেতা। যে ভারতের বৃহত্তম ন্যাশনাল পার্টির সদস্য, যার সবথেকে বড় ক্ষোভ হল রাজ্য-রাজনীতিতে সে সারা জীবন দু’নম্বর ভয়েস হয়েই রয়েছে।
কাট
‘নৈহাটি সময় ১৪০০’-র প্রযোজনায় ‘খড়ির তীর’ নাটকটার প্রধান চরিত্রের জীবনটা ঠিক এ রকম ভাবেই দেখিয়েছেন অর্পিতা ঘোষ। নাটকটা শুধু যে তিনি পরিচালনা করেছেন তাই নয়, অভিনয়ও করেছেন মুখ্য ভূমিকায়। শহরের চার দিকে এই নাটকের হোর্ডিং। তাতে বড় বড় ফন্ট-য়ে লেখা ‘এক অভিনেত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী...একটি হত্যা...’
কে এই অভিনেত্রী?
যাঁর ছায়া নাকি অর্পিতা দেখতে পেয়েছিলেন প্রথম বার নাটকটি পড়ে?
নাম নিতে চান না অর্পিতা। শুধু বলেন, “কার ছায়ায় নাটকটা
অলোক বিশ্বাস লিখেছে, সেটা পড়েই বুঝতে পেরেছি। থিয়েটারের সকলেই এই সব ঘটনা কমবেশি জানেন। হতেই পারে দর্শকও কোনও সাংসদের সঙ্গে এই চরিত্রের মিল খুঁজে পাবেন। যাঁরা ইতিহাসটা জানেন না, তাঁদেরও গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগবে।”
|
মঞ্চে ‘খড়ির তীর’
|
তা হলে দর্শক যদি তাঁর এই নাটকের আড়ালে কোনও রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা খুঁজতে বসেন? জল্পনা শুরু করেনএই সময়টাই কেন অর্পিতা ঘোষের মতো নাট্যকর্মী এমন একটা নাটক পরিচালনা করার জন্য বেছে নিলেন? “নাটকটার কথা আমি আগে জানতাম না। অলোক যখন প্রথমে আমাকে এটা করতে বলে আমি তখন ওকে জানাই যে আমি স্ক্রিপ্টটা না পড়ে মত দেব না। পড়ার পর বুঝলাম যে নাটক আর চরিত্র যথেষ্ট অভিনেয়। ঘটনাক্রমে কেউ নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। তবে এইটুকু বলব অলোক কিন্তু একপেশে একটা চরিত্র লেখেনি। কাউকে আক্রমণ করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে ছোট্টবেলা থেকে এই মেয়েটিও যে অনেক অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। মেয়েটির অসহায়তাও দেখানো হয়েছে। আর পরিচালক হিসেবে এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং একটা নাটক। তা ছাড়া রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নাটকের প্রতি আমার একটা স্বাভাবিক ঝোঁক আছেই।”
নাট্যকার অলোক বিশ্বাস এই প্রথম কোনও পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক লিখলেন। ‘খড়ির তীর’য়ে তিনি এক ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। যিনি এই অভিনেত্রীকে নানা প্রশ্ন করে তার অতীত সম্পর্কে জানতে চান। কী উদ্দেশ্য ছিল তাঁর এমন একটা নাটক লেখার পেছনে? “এই নাটকটা লিখতে আমার এক বছর সময় লেগেছে। একজন লেখককে কোন গল্প ‘হন্ট’ করবে সেটা বলা কঠিন। বহু বছর আগে একটা টেলিফিল্মে আমি অভিনয় করেছিলাম। নাম ছিল ‘পুলিস ফাইল।’ পরিচালক ছিলেন ফাল্গুুনী সান্যাল। টেলিফিল্মে আমি এক ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের ভূমিকায় ছিলাম। সেই টেলিফিল্মের গল্পটা ছিল মফস্সলের এক থিয়েটারকর্মী অস্বাভাবিক ভাবে নিরুদ্দেশ হওয়াকে কেন্দ্র করে। যার সঙ্গে এক অভিনেত্রীর সম্পর্ক ছিল। পরে এই অভিনেত্রীর এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সম্পর্ক হয়। সেই টেলিফিল্মে নিরুদ্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মীর বডি যে পাওয়া যায়নি সেটা বলা হয়েছিল। আমার নাটকে মুখ্য চরিত্র হল সেই অভিনেত্রী। তবে আমি কাউকে আঘাত করে নাটকটা লিখিনি,” জানাচ্ছেন অলোক।
ফাল্গুনী সান্যাল রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র ছিলেন। ‘খড়ির তীর’ নাটকটা সম্পর্কে শুনেছেন। তিনি বললেন, “নাটকটার গল্পটা শুনে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে এক অভিনেত্রীর সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন হঠাৎ রিহার্সাল থেকে সে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। আমি এই ঘটনা অবলম্বনে ২০০২ সালে একটা টেলিফিল্ম বানিয়েছিলাম।”
নাটকের শেষ দিকে একটা সংলাপও রয়েছে, “আমি জানতাম যে ক্ষমতার মেরুকরণ বদলাবে। তখন মাটির তলা থেকে আমার অতীত ইতিহাস খুঁড়ে বের করা হবে।” কখনও ভেবে দেখেছেন যে, যদি ক্ষমতার মেরুকরণ পাল্টে যায়, তা হলে এমন একটা নাটক লেখার জন্য তাঁকেও কোনও দিন জবাবদিহি করতে হতে পারে? অথবা নাটকটা নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে?
“দশ বছর পরে কী হবে, অত ভেবে নাটক লিখিনি। তা ছাড়া আমি রঞ্জাবতী দাসের গল্পটাই বলতে চেয়েছি,” বলছিলেন নাট্যকার।
রঙ্গপট দলের অভিনেতা কমল ব্রহ্ম। এই নাটকে অভিনয় করছেন ওই রাজনীতিকের চরিত্রে। বলছেন, “আমিও নাটকটা পড়ে কার জীবনের ছায়াতে লেখা তা বুঝতে পেরেছি। তবে আমি পেশাদার অভিনেতা। পেশাদার অভিনেতাদের কোনও রং হয় না। নাটকে আমার চরিত্রের নাম সুধাময় দাস। নাটকের শেষে দেখা যায় তিনি খুব অসুস্থ।” |
|
আমি কাউকে আঘাত করে নাটকটা লিখিনি
অলোক বিশ্বাস, নাট্যকার |
|
সেনসেশন না নাটকের জোর? নাট্যমেলায় এমন একটা প্রযোজনা কেন দর্শককে আকর্ষণ করবে বলে অর্পিতার ধারণা? “আমার মনে হয়, থিয়েটারের জোরেই লোকে নাটকটা দেখতে যাবেন। খোঁচা দেওয়া হবে বলে নাটকটা করিনি। নাটকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেও করা হয়নি।”
যদি প্রশ্ন ওঠে, নিজে একজন নাট্যকর্মী হয়ে ভোটের আগে এই রকম একটা নাটক করে কি খানিকটা কুৎসা রটিয়ে হেডলাইনে থাকতে চাইছেন অর্পিতা? “প্রথমেই বলি, এই নাটকটা আমি লিখিনি। আমার দল এই নাটকটা করছে না। না, কোনও কুৎসা নয়। এটাকে আমি রঞ্জাবতী দাসের গল্প বলে মনে করি। শুধু কুৎসা করতে হলে চরিত্রের অন্যান্য অ্যাসপেক্টগুলো আসত না। এই স্ক্রিপ্টটা ওয়ান-ট্র্যাকড নয়। একজন মানুষ দোষে-গুণে তৈরি। সেটাই দেখানো হয়েছে। আমি এমন এক চরিত্রকে নিয়ে কাজ করছি যে এক সময় ছেড়া ফ্রক পরত। আজ সে পরে স্ট্রেচড জিনস আর শার্ট। তার সোনালি চুল। পায়ে উঁচু হিল জুতো। আমি কুৎসা করতে চাইলে বাস্তবজীবনের কাউকে মাথায় রেখেই রঞ্জাবতীকে সাজাতাম। আরও পরিষ্কার করে দিতাম। কিন্তু আমি কোনও সাদৃশ্য চাইনি।”
যাঁর ছায়ায় নাকি নাটকটি লেখা, তাঁকে শো দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেও পরিচালকের আপত্তি নেই। বললেন, “যিনি দেখবেন, তাঁর যদি অসুবিধা না হয়, তা হলে আমারই বা নাটকটাকে দেখাতে আপত্তি হবে কেন?”
নাটকে বারবার জুলাই কনভেনশনের কথা উঠে এসেছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে এক জননেত্রীর কথা। অর্পিতা কি এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও অনুরোধ করবেন নাটক দেখার জন্য? এ প্রশ্নের উত্তরে অর্পিতা জানান, “আমি স্টার থিয়েটারে ১৮ জানুয়ারি-র শো-তে দিদি-কে আমন্ত্রণ জানাব। যদি উনি আসতে পারেন, ভাল লাগবে।” |
|
|
|
|
|