পাহাড়পুরে বোমা বিস্ফোরণের পরে সারা জলপাইগুড়ি শহর জুড়েই শুরু হয়েছে কড়া নজরদারি। তা থেকে বাদ যায়নি বইমেলার মাঠও। সেই জন্য প্রত্যেককেই মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেওয়ার আগে তল্লাশি করা হচ্ছে ভাল করে। বৃহস্পতিবার বিস্ফোরণের পরে শুক্রবার মেলায় লোকও এসেছেন কম। বিকেলে মাঠ এক রকম ফাঁকাই ছিল। সন্ধ্যায় সামান্য লোক বাড়ে। এ দিন বইমেলার প্রচার কমিটির আহ্বায়ক বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, “অন্য দিনের তুলনায় ২০ শতাংশ কম টিকিট বিক্রি হয়েছে।” চাঁদের পাহাড় তার মধ্যেও ধরে রাখতে পেরেছে জনপ্রিয়তা। এই দিন যাঁরা বইমেলায় এসেছেন, তাঁদের কেউ কিনেছেন নিজের জন্য, কেউ কিনেছেন বাড়ির ছোটদের জন্য। কিন্তু এ কথা ঠিক, সেই কৈশোরে পড়া উপন্যাসটি যাঁরা হাতে পাচ্ছেন, আরও একবার তাতে নজর বুলিয়ে নেওয়ার লোভ আটকাতে পারছেন না কেউই।
শঙ্করের আফ্রিকা অভিযান এই পরিস্থিতিতেও বইমেলার আলোচ্য বিষয়। উগান্ডার প্রান্তের রেলস্টেশনের সিংহ, সাপ থেকে হিরের খনির সন্ধানে দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনি যেন ফের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে পাঠকের। কিন্তু শঙ্করের সেই অভিযানের কথা জানতে গোটা শহরের কচিকাঁচা থেকে বয়স্করা কতটা উৎসাহী হয়ে উঠেছেন, তা জানতে ঢুঁ দিতে হবে দু’টি জায়গায়। |
এক, সিনেমা হলে।
দুই, ফণীন্দ্রদেব হাইস্কুলের ময়দানে বইমেলা প্রাঙ্গণে। জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র কদম তলার সিনেমাহলে ২০ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে তৈরি ‘চাঁদের পাহাড়’। ইতিমধ্যেই দেব অভিনীত এই ছবিটি আলাদা চাহিদা তৈরি করেছে। সে জন্য অনেকে হাতের কাছে বইমেলায় ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসটির খোঁজ করছেন। তা হাতে মিলে যাওয়ায় কার্যত দুই ঢিলে একই পাখি মারতে উঠেপড়ে লেগেছে তরুণ প্রজন্ম।
তাই সিনেমা দেখা এবং বইমেলা কোনওটিকেই ছাড়তে চাইছে না উৎসাহীরা। তাই হলের সামনে যেমন উপচানো ভিড়, তাই বইমেলায় আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর জন্য হুড়োহুড়ি। স্টলে গিয়েই বিক্রেতাকে বই প্যাক করে বিল বানাতে বলছেন অধিকাংশ। বই হাতে নিয়ে দেখার সুযোগটুকুও নষ্ট করতে চাইছেন না তাঁরা। পাছে অর্ডার দিতে দেরি হলে বইটি হাতছাড়া হয়ে যায়! কেউ চাইছেন বই পড়েই হলমুখো হতে। কেউ আবার ছবিটি দেখে তার পরে বইটি পড়তে চাইছেন। তাই হল থেকে সটান ঢুকে পড়ছেন বইমেলার নির্দিষ্ট স্টলে চাঁদের পাহাড়ের খোঁজে।
মেলার প্রথম দিন থেকেই খোঁজ নিতে শুরু করেছিল কচিকাঁচারা। বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই। যে পরিমাণ বই আনা হয়েছিল, ইতিমধ্যেই তার অধিকাংশ বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যেটুকু পড়ে রয়েছে তা-ও খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে বলে প্রকাশনা সংস্থার কর্মীরা জানিয়েছেন। এক কর্মীর কথায়, বইমেলার সময়েই ছবিটি মুক্তি পাওয়ায় আমাদের সুবিধা হয়েছে। অনেকেই ছবিটি দেখার পর বইটি পড়ার জন্য উদগ্রীব। তাই তাঁরা আসছেন সেই শখ মেটাতে।
অয়ন, শঙ্খ, পৌলমী, বকুল, জয়দীপরা বড়দিনে দল বেঁধে হাজির হয়েছিল বইমেলায় চাঁদের পাহাড়ের খোঁজে। অয়ন জানান, সিনেমা দেখার আগে মূল বইটা পড়ে নিতে চান। শুধু নিজের জন্যই নয়, বড়দিনে অনেকে চাঁদের পাহাড় কিনছেন অন্যকে উপহার দিতেও। বস্তুত চাঁদের পাহাড় নিয়ে আলোচনা এখন স্কুলপড়ুয়া থেকে রাজনীতিকদেরও মুখে মুখে।
বইমেলায় একবার ঢুকে পড়লে কেএলও, বিস্ফোরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা কমে যাচ্ছে। তখন আলোচনায় উঠে আসছে শঙ্কর এবং তার অভিযানের কথা। তৃণমূল নেতা তথা শহরের এক প্রাক্তন কাউন্সিলর সোমনাথ পাল বলেন, “চাঁদের পাহাড় নিয়ে যে হইচই হচ্ছে তা ঘরে বসেই টের পাচ্ছি। দিনে দশ জন লোকের সঙ্গে কাজকর্ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখছি, সেখানেও অন্তত আট জনেরই চাঁদের পাহাড় নিয়ে আলোচনা। বাড়ির সামনে সিনেমাহল, সেখানেও চাঁদের পাহাড় চলছে। বইমেলাতেও শুনছি চাঁদের পাহাড় নিয়ে হুড়োহুড়ি।” সাহিত্যিক জ্যোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী জানান, “আমি বহু বার পড়েছি এই ক্লাসিক বইটি। তা নিয়ে এখনও যে মাতামাতি হচ্ছে, সেটাই বড় ব্যাপার। মহৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে।”
|