লালমোহনকে জঙ্গি লিঙ্কম্যান বলায় বিক্ষোভ
চোখের সামনে সাইকেলটাকে শূন্যে উঠে টুকরো-টুকরো হতে দেখেছেন কেউ। দেখেছেন, মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে সাইকেল আরোহীর দেহ। বাইক থেকে ছিটকে অদূরে আছড়ে পড়েছে ৩ তরুণ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পাহাড়পুরের বজরাপাড়ার সেতু। তারপরে আর্তনাদ, চেঁচামেচি, হট্টগোল, পুলিশের জিপ, অ্যাম্বুল্যান্সের ছোটাছুটি থামতেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শোকে নিঝুম হয়ে গিয়েছিল জলপাইগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে বজরাপাড়া। কিন্তু বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে যাঁর, সেই সাইকেল আরোহী লালমোহন দেবনাথকে ‘জঙ্গিদের লিঙ্কম্যান’ সন্দেহ করায় বজরাপাড়ার মানুষ শোক ভুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
শনিবার সকাল থেকে রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানান তাঁরা। পুলিশ-প্রশাসন কেন তদন্ত সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই একজনকে জঙ্গিদের লিঙ্কম্যান সন্দেহে করেছে, সেই প্রশ্ন ওঠে। ক্ষুব্ধ জনতার রোষে ভাঙচুর হয় ৩টি বাইক। একটা সময়ে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, নিহত ও আহতদের বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানানোর জন্য বেরোতে গিয়ে থমকে যেতে হয় রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও গৌতম দেবকে। পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কাও করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুলিশ-প্রশাসন, শাসক দল তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যস্থতায় অবস্থায় আয়ত্তে আসে। ইতিমধ্যে পুলিশের তরফেও বজরাপাড়ার বাসিন্দাদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রাথমিক ভাবে লালমোহনবাবুর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ করা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গি যোগসাজশে যুক্ত থাকার কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলেনি। শুধু তাই নয়, দুই মন্ত্রী সুব্র্রতবাবু ও গৌতমবাবু লালমোহনবাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজনদের সমবেদনাও জানান। সেখানে কেন লালমোহনবাবুকে লিঙ্কম্যান সন্দেহ করা হয়েছে, সেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় দুই মন্ত্রীকে। তবে রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “আমরা গোটা ঘটনায় বিচলিত ও উদ্বিগ্ন। সেই জন্য তো সমবেদনা জানাতে এসেছি। আপনাদের পাশে আমরা আছি।”
পরে ওই এলাকায় যান সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম, বিধায়ক তথা প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও। নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানান তাঁরাও। তবে শাসক দলের মন্ত্রী কিংবা বিরোধী দলের নেতা, সকলের সামনেই গ্রামবাসীরা পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশি নজরদারি না থাকাতেই বিস্ফোরণে অকাল মৃত্যু হয়েছে এলাকার ৫ বাসিন্দার। সেই সঙ্গে পুলিশ ভাল ভাবে তদন্ত না করেই লালমোহনবাবুর নাম কেএলও-র সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লালমোহনবাবু বাড়ি ফিরছিলেন। সে সময়ে ধরধরা নদীর উপরে সেতুর একপাশে একটি ব্যাগ রাখা দেখে তিনি সেটি তুলেছিলেন। ব্যাগের ভিতরে একটি টিফিন কৌটো দেখে নিছকই কৌতূহলী হয়ে খুলতে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনার সময়ে লালমোহনবাবুর সঙ্গে কোনও সাইকেলই ছিল না বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজনের দাবি। আগে থেকেই সেতুতে কেউ বা কারা বোমা সহ ওই ব্যাগ রেখে গিয়েছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। সেই দাবি নিয়ে অবশ্য এ দিন পুলিশের তরফে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি। জেলা পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি
বলেন, “তদন্ত চলছে. এখন কোনও মন্তব্য করব না।”
লালমোহনবাবু যে এলাকায় নির্বিরোধী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তা এখন পুলিশের অনেকেও মানছেন। ইন্দিরা কলোনি বাজার সহ এলাকার কয়েকটি বাজারে মাঝে মধ্যে মাংস কাটার কাজ করতেন। এ ছাড়া দিনমজুরিও করতেন। তাঁর ছেলে শহরের দিনবাজারের একটি মাছের দোকানে কাজ করেন। স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে-জামাই এবং এক নাতনি নিয়ে ৫ জনের সংসারে লালমোহনবাবুই মূল উপার্জনকারী।
বজরাপাড়ার গলির বাঁক ঘুরতেই এক চিলতে উঠোনের পাশে দোচালা একটা ঘর। শুক্রবার সকাল থেকেই ঘরের চৌকাঠে ঠায় বসে ছিলেন সাবিত্রীদেবী। লালমোহনবাবুর পড়শিরা শত চেষ্টাতেও তাকে চৌকাঠ থেকে দুপুর পর্যন্ত নড়াতে পারেননি। লালমোহনবাবুর মেয়ে সান্ত্বনা বাড়িতে আসা সকলকেই একই প্রশ্ন করছেন সকাল থেকেই, “আচ্ছা পুলিশ বাবাকে জঙ্গি বলল কেন? বাবা কোনওদিন কারও সঙ্গে শত্রুতা করেনি।”
জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণ কাণ্ডে গুরুতর আহত দু’জনকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁদের দু’জনেরই অবস্থা গুরুতর। এর মধ্যে সূর্য রায়ের অবস্থা একটু ভাল। তাঁর পেটে বড় ধরনের আঘাত রয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার শেখররঞ্জন বসু বলেন, “একই রকম অবস্থা থাকলে তাকে ভেন্টিলেশনের বাইরে নিয়ে আসা হবে। তবে আরও চার পাঁচদিন না গেলে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়।” বিস্ফোরণে আহত মহম্মদ রফিকুলের মাথা থেকে টিনের চাকতির মতো একটি জিনিস অস্ত্রোপচার করে বের করা হয়েছে। তাঁর ডান দিকের চোখ সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গিয়েছে।
সূর্যবাবুর কাকা নৃপেন রায় বলেন, “সূর্য পড়াশোনা করে। ও এদিন বন্ধু অঞ্জনের সঙ্গে দিদির বাড়িতে গিয়েছিল। দিদির বাড়ি থেকে ফেরার পথে সেতুর ওখানে এই ঘটনা ঘটে। অঞ্জন মারা গিয়েছে। সূর্য আহত।” এর বেশি কিছু বলতে পারেননি তিনি। ওইদিন তাঁরা সামনেই নদীর বাঁধের উপরে বসেছিলেন। বোমা ফাটার আওয়াজ পেয়েছেন। পরে শোনেন, কয়েকজন লোক মারা গিয়েছেন। তখনও জানতেন না তাঁর নিজের ভাইপোই ছিল ঘটনাস্থলে।






First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.