বাক্সে খাবার নাকি! খুলতেই বিস্ফোরণ
ন্ধ্যা ৬টা নাগাদ কালো রঙের একটি মোটরবাইকে চেপে দুই যুবক ঘরঘরিয়া সেতুর উপরে এসে দাঁড়ান। নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে এক জন সিগারেটও ধরান। তাঁরা চলে যেতেই গরু চরিয়ে বাড়ির দিকে ফিরে যাওয়ার সময়ে এক মহিলা প্রথম দেখতে পান, সেতুর রেলিংয়ের ধারে একটি ব্যাগ পড়ে রয়েছে। মহিলার কৌতূহলী ডাকে দ্রুত ভিড় জমে যায়। উঁকি দিয়ে দেখা যায়, ক্যারিব্যাগের মধ্যে ঢাউস টিফিন কেরিয়ার। অত্যুৎসাহী কয়েক জন্য কী আছে দেখতে এগিয়ে এলেও, বাকিরা তাঁদের সতর্ক করে ব্যাগ-সহ টিফিন বাক্সটি নদীতে ছুড়ে ফেলার পরামর্শ দেন। ওই সময়ে সেখান দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন লালমোহন দেবনাথ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাইকেল থেকে নেমে লালমোহনবাবু ‘টিফিন বাক্সে খাবার আছে মনে হচ্ছে’ বলে সেটি খুলতে যান। এর পরেই বিস্ফোরণ। যে ঘটনায় প্রাণ হারান লালমোহন-সহ পাঁচ জন। প্রাথমিক তদন্তের পরে যে ঘটনার জন্য কেএলও-কে কাঠগড়ায় তুলেছেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
কান্নায় ভেঙে পড়েছেন লালমোহন দেবনাথের স্ত্রী (বাঁ দিকে)।
কেএলও কিন্তু পুলিশের অভিযোগ মানতে নারাজ। এ দিন বিস্ফোরণের দায় অস্বীকার করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কৈলাস কোচ এক প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কামতাপুরির মানুষদের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি তৈরির চেষ্টা করছে। এ ভাবে নিজেদের অমানবিক কাজকে ধামাচাপা দিতে চাইছে সরকার।” কেএলও-র সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, ২৬ ডিসেম্বর দিনটি তাঁদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কেএলও-র ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে স্মরণীয়। এমন দিনে কামতাপুরির কোনও মানুষ শহিদ হোন, সেটা কেউ চায় না বলেও জানিয়েছেন কৈলাস। শেষে তাঁর বক্তব্য, “আমরা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে সাবধান করে দিচ্ছি, যাতে আমাদের সংগঠনের নাম করে নিরীহ মানুষের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা না হয়।”
পুলিশ কিন্তু বলছে, নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই কেএলও এখন ওই বিস্ফোরণের দায় অস্বীকার করছে। সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, “কেএলও নিজে বিপাকে পড়েই এখন মিথ্যে দাবি করছে।” কী ভাবে বিপাকে পড়েছে কেএলও? আইবি-র এক কর্তার বক্তব্য, “বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে এক জন রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। আহতদের মধ্যেও দু’জন রাজবংশী। অথচ এই কেএলও-ই দাবি করে, তারা রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়ন চায়, আলাদা রাজ্য চায়। সে জন্যই নিজেদের ঘাড় থেকে বিস্ফোরণের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে কেএলও।”
আইবি-র এক কর্তার বক্তব্য, সাম্প্রতিক অতীতেও কেএলও দু’টি হামলার ঘটনায় দায় অস্বীকার করেছিল। এ বছরের ১৭ জুন মালদহের হবিবপুর এলাকার বাসিন্দা নৃপেন মণ্ডলকে তারা গুলি করে খুন করে। আবার ২৫ জুন মালদহেরই গাজলে মোটরসাইকেল থেকে তারা বোমা ছোড়ে। ওই ঘটনায় জনা দশেক মানুষ জখম হন। কেএলও এই ঘটনার দায় অস্বীকার করলেও তদন্তে বেরোয়, দু’টি ঘটনাতেই তারা জড়িত।
বিস্ফোরণস্থল দেখছেন এনআইএ-র এক তদন্তকারী।
গোয়েন্দারা কেন মনে করছেন, এই বিস্ফোরণ কেএলও-রই কাজ?
তদন্তকারীদের বক্তব্য, প্রথমত, বারবিশা, আলিপুরদুয়ারের বিস্ফোরণগুলির সঙ্গে বৃহস্পতিবারের বিস্ফোরণের মিল রয়েছে। আগেরগুলি সবই কেএলও-র কাজ। দ্বিতীয়ত, জীবন সিংহ-সহ কেএলও নেতাদের যে টেলিফোন কথোপকথন গোয়েন্দারা শুনেছেন, তাতে এই ধরনের হামলা হবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছে কেএলও-র ভাইস চেয়ারম্যান টম অধিকারী। রূপায়ণের দায়িত্ব ছিল কেএলও-র অর্থসচিব নীলাম্বর রাজবংশী ওরফে ‘ডাক্তারে’র উপর। স্থানীয় কোন কোন কেএলও জঙ্গি এতে জড়িত, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশ সূত্রের খবর, এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ময়নাগুড়ির এক যুবককে পুলিশ জেরা করছে। তিনি জলপাইগুড়িতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। শুক্রবার জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র একটি দল গুয়াহাটি থেকে জলপাইগুড়িতে পৌঁছয়। সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডও বিস্ফোরণস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। এনআইএ-র তরফে জানানো হয়েছে, বিস্ফোরণে আইইডি-ই ব্যবহার করা হয়েছে। কালভার্টের আশপাশে পড়ে থাকা স্প্লিন্টার সংগ্রহ করা হয়েছে। কালভার্টের নীচে জল থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে একটি চামড়ার টুকরো।
তদন্তকারীরা শুনছেন প্রত্যক্ষদর্শীদের কথাও। দুই রহস্যজনক যুবক, বাক্স পড়ে থাকা এবং লালমোহনের উদয় এ সব বিবরণ থেকে কিন্তু আরও নতুন প্রশ্ন উঠে এসেছে। যেমন, ওই দুই যুবকই কি টিফিন বাক্স রেখে যান? টিফিন বাক্স কি ওখানেই রাখার কথা ছিল, নাকি অন্য কোথাও পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল? ঘটনাস্থলের অদূরে দু’টি রেল স্টেশন, একটি বাস স্ট্যান্ড। খানিকটা এগোলে জলপাইগুড়ির ব্যস্ততম কদমতলা মোড়। ডিএম-এসপি অফিস লাগোয়া এলাকাই কি লক্ষ্য ছিল?
বিস্ফোরণ টাইমারের সাহায্যে, নাকি ব্যাটারির সংযোগে ঘটানো হয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। প্রশ্নগুলির থেকে ধোঁয়াশা বেড়েছে বই কমেনি। কিন্তু একটা বিষয় প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট। তা হল, সামনে যে-ই থাকুক, জলপাইগুড়ির বিস্ফোরণের নেপথ্যে বড় মাথা আছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব নিজেই বলেন সে কথা। ঘটনাস্থল ঘোরার পরে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও।
এনআইএর তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি আলিপুরদুয়ার চৌপথি এবং বারবিশার বাসে একই রকম বিস্ফোরক রাখা ছিল। ওই দুই ক্ষেত্রেই কেএলও-র জড়িয়ে থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। আলিপুরদুয়ারের ঘটনায় কেএলও লিঙ্কম্যান-সহ কেএলও নেতা টম অধিকারীর ঘনিষ্ঠ মেনকা রায়কেও গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, টমের গতিবিধি রয়েছে নেপালেও। সম্প্রতি নেপালের একাধিক নম্বর থেকে ফোন করে উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীর থেকে টাকাও দাবি করা হয় বলে অভিযোগ।
নবান্ন সূত্রেরও খবর, প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, পিছন থেকে যারা কলকাঠি নেড়েছে, তারাই কোনও জঙ্গি সংগঠনকে দিয়ে ওই কাজ করিয়েছে। সরকারের শীর্ষ মহলের দাবি, জলপাইগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গে আরও নাশকতা ঘটাতে ১০-১২ জন জঙ্গির একটি দল এ রাজ্যে ঢুকেছে।
পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আজ, শনিবার জলপাইগুড়ি সহ গোটা উত্তরবঙ্গে ‘হাই অ্যালার্ট’ জারি করেছে রাজ্য। আজ কেএলও-র প্রতিষ্ঠা দিবস। তাই তারা ফের নাশকতার চেষ্টা করতে পারে বলেও গোয়েন্দাদের আশঙ্কা। নবান্ন সূত্রে জানানো হয়, বিস্ফোরণে গুরুতর জখমদের এক লক্ষ টাকা এবং যাঁদের আঘাত ততটা গুরুতর নয়, তাঁদের পঞ্চাশ হাজার টাকা সাহায্য দেওয়া হবে।

ছবি: সন্দীপ পাল।





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.