পেশাদারি পথেই মমতার মন্ত্রী বদল
ভাল কাজ করলে পুরস্কার, ব্যর্থ হলে বিদায় রাজ্য মন্ত্রিসভার সাম্প্রতিক রদবদলে কর্পোরেট জগতের এই মূল মন্ত্রের প্রতিফলনই দেখছেন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের অনেকের মতে, রাজনৈতিক সমীকরণ বা আনুগত্য নয়, শুধু সাফল্য-ব্যর্থতার বিচার করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে ১৪টি দফতরে রদবদল করেছেন, প্রশাসনিক নিরিখে তা প্রশংসনীয়। সাড়ে তিন দশকের শাসনে যা করে উঠতে পারেনি বামফ্রন্ট।
বহুজাতিক সংস্থার কর্তাদের একটা বড় অংশের মতে, মানবসম্পদ বিভাগের কাজই হল নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংস্থার কর্মীদের মূল্যায়ন। যাঁরা ভাল কাজ করলেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা। যাঁরা পারলেন না, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে ভাল কাজ করতে পারেন, সে জন্য তৈরি করা। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত তাঁদের বিদায় করাই এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ।
মমতার মন্ত্রিসভার রদবদলে এই কর্পোরেট প্রক্রিয়ার ছাপ পড়ল কী ভাবে? মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা শিল্প দফতরের ভার পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে অমিত মিত্রকে দেওয়াটাই মূল উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছেন। কারণ, তৃণমূল সূত্রই বলছে, পার্থবাবুর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কে রদবদলের কোনও খবর নেই। বরং মমতা তাঁর ‘পার্থদা’-কে এখনও বেশ পছন্দই করেন। দল পরিচালনার অনেক বিষয়ে তিনি তৃণমূল মহাসচিবের উপরে নির্ভরশীল।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন রাজ্যে লগ্নি টানা এবং শিল্পবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার কথা মমতা ভেবেছেন, তখন পার্থবাবুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেননি বলেই মত মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলছেন, গত আড়াই বছরে রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে যে আহামরি কিছু হয়নি, তা বুঝতে পেরেছেন মমতা। এটাও বুঝেছেন যে, এখনই কিছু না-করলে আড়াই বছর পরে বিধানসভা ভোটের সময় রাজ্যের শিক্ষিত বেকারদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তাঁকে। তাই তিনি নির্ভর করেছেন দীর্ঘ ১৫ বছর দেশের শিল্প-বণিক মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা অমিতবাবুর উপরে। যিনি মুম্বইয়ে মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প সম্মেলন আয়োজন করার দায়িত্ব পেয়ে প্রথম দফাতেই সফল। কঠিন সময়ে সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবেও।
মুখ্যমন্ত্রীর এই মূল্যায়ন-ভিত্তিক রদবদল নিয়ে উচ্ছ্বসিত মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ বীর্যেন্দু গুপ্তের মন্তব্য, “দৃষ্টান্তমূলক! এ সব তো কর্পোরেট সেক্টরে হয়ে থাকে। রাজনৈতিক কারণ বা দুর্নীতির ঘটনায় মন্ত্রিত্ব বদলের কথা শুনেছি। কিন্তু মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন করে, মার্কশিট বানিয়ে তার পর দফতর বদলানো সম্ভব বলেই মনে হতো না।” তাঁর মতে, শুধু মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে নয়, সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রেও এমন মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হলে বাংলায় সুশাসন ফিরবে।
মমতার পদক্ষেপকে কেন দৃষ্টান্তমূলক বলা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাম আমলের উদাহরণ টানছেন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, জ্যোতি বসুর আমলে কখনওই মন্ত্রীদের কর্মদক্ষতা বিচার করা হয়নি। দলে বিভিন্ন জেলার শক্তির সমীকরণ এবং শরিকদের স্বার্থরক্ষাই ছিল শেষ কথা। ফলে মন্ত্রী অদক্ষ হলেও তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে জ্যোতিবাবুকে। জমানার শেষ দিকে এক বার মন্ত্রিসভায় ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু দলের চাপে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ১১ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বও সেই একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি বলে মনে করছেন ওই বিশেষজ্ঞরা। তাঁকেও মন্ত্রীদের গুণগত মানের সঙ্গে সমঝোতা করেই চলতে হয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও সরাতে পারেননি বয়স্ক মন্ত্রীদের। বস্তুত, বাম আমলে এক বার মন্ত্রিসভা গঠনের পরে তাতে রদবদল ছিল বিরল ঘটনা। মমতা ইতিমধ্যেই তিন বার মন্ত্রিসভার রদবদল করেছেন।
তবে পশ্চিমবঙ্গে বিরল হলেও অন্য রাজ্যে এমন রদবদল হামেশাই ঘটে বলে জানাচ্ছেন বহুজাতিক মহলে মানবসম্পদ গুরু বলে পরিচিত জাহিদ এইচ গানজি। তাঁর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনা চমকপ্রদ মনে হলেও অন্যত্র এমন মূল্যায়ন ব্যবস্থা আগে থেকেই চালু রয়েছে।” এবং সেটা শুধু সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে নয়। সম্প্রতি রাহুল গাঁধী যুব কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃত্ব বাছাই করেছেন রীতিমতো লিখিত পরীক্ষা এবং সাক্ষাৎকার নিয়ে। কলকাতার দুই মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ সেই বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদেরই এক জন জানাচ্ছেন, হাতেগোনা কয়েকটি পদের জন্য প্রায় ২০০০ দরখাস্ত জমা পড়েছিল। দীর্ঘ বাছাই পর্বের মধ্যে দিয়ে রাহুলের ‘টিম’ বাছা হয়েছে। মাস ছয়েক আগে এই নিয়োগের পর তাঁরা এখন দলীয় প্রশিক্ষণে রয়েছেন। লোকসভা ভোটে এই যুব নেতারা আত্মপ্রকাশ করবেন।
দিল্লিতে যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এ বার মমতার হাত ধরে তা এ রাজ্যে এলে ভালই হবে, বলে মনে করছেন রাহুলের টিম নির্মাণের দায়িত্বে থাকা এক বিশেষজ্ঞ। আর গানজি বলছেন, এ পথে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। তাঁর ব্যাখ্যা, “রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। সেই জায়গা দখল করছে আম আদমি পার্টির মতো শক্তি। দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলিকে তাই স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করতেই হবে।”
সেই স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখার প্রথম ধাপে শুধু শিল্প নয়, আরও ১৩টি দফতরকে মমতা সামিল করেছেন বলেই মনে করছেন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের একাংশ জানাচ্ছেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নুরে আলম চৌধুরি প্রথম দিন থেকেই প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরে তেমন স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। টাউন হলের মূল্যায়ন পর্বে এই দফতরের কাজ নিয়ে ক্ষোভ চেপে রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী। এবং নুরে আলম চৌধুরিকে সরিয়ে তিনি বর্ধমানের গ্রামের মানুষ স্বপন দেবনাথকে প্রাণিসম্পদের ভার দিয়েছেন। কাজে অসফল হওয়ায় হিতেন বর্মনকে বনমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিতেও পিছপা হননি।
একই ভাবে পেশায় চিকিৎসক শশী পাঁজাকে নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের ভার দিয়েছেন মমতা। ‘মা ও শিশুর’ পুষ্টি এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে শশীদেবীর। এর আগে কলকাতা পুরসভা এলাকায় কাজও করেছেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মমতা বুঝেছেন, শুধু শিল্পেই হবে না, মানব উন্নয়নের সূচকেও উপরের সারিতে আসা দরকার। আবার সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের নেতা বেচারাম মান্নাকে বেছেছেন জমি অধিগ্রহণ দফতরের জন্য।
তবে পার্থবাবুর হাতে তথ্য-প্রযুক্তি দফতরও না-রাখলে চলত বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কেন এই দফতর অমিতবাবুর হাতে গেলে ভাল হতো তার যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলছেন: প্রথমত, তথ্য-প্রযুক্তি অনেকটা শিল্পেরই অনুসারী দফতর। তা ছাড়া, মমতা নিজেই যখন বলেছেন যে, পার্থবাবুকে দলের মহাসচিবের ভূমিকায় বেশি করে দেখতে চান তিনি, তখন তাঁর হাতে শুধু পরিষদীয় দফতর রাখাই যুক্তিযুক্ত হতো। আর বালুচরী যেখানে তৈরি হয়, সেই এলাকার বিধায়ককে বস্ত্রমন্ত্রী করার মধ্যেও কোনও অভিনবত্ব দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ক্ষুদ্র শিল্প অথবা শিল্প দফতরের সঙ্গেই রাখা যেত এই দফতর।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.