পুস্তক পরিচয় ২...
বড় মমতায় মানুষের কথা লিখেছেন
পথে পথে, পরিমল গোস্বামী। সপ্তর্ষি, ২০০.০০
বনপথের পাঁচালী,
পরিমল গোস্বামী। সপ্তর্ষি, ১২৫.০০
থে রাতের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে পরিমল গোস্বামী ভাবছেন বিভূতিবাবুর কথা। ‘তিনি আরাকান, আসাম, পূর্ণিয়ার অরণ্যপ্রদেশে ঘুরেছেন, তাই আমাদের তেমনি অ্যাডভেনচারে দীক্ষা দেওয়ার জন্যই গ্রিন্ডোলা গ্রামে ভাত নিজে খেয়েছেন, আমাদের খেতে দেননি। ফেরার পথে পাছে আমি গাড়িতে উঠে অন্যায় করি সে জন্য তিনি ওটা দখল করে রইলেন। তিনি সত্যিই প্রকৃত গুরুর কাজ করেছিলেন। অ্যাডভেনচারে দীক্ষাগুরু।’ ১৯৩৩-এর মার্চে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকার তরফে বিভূতিভূষণ যাচ্ছিলেন ওড়িশার বিক্রমখোল, নবাবিষ্কৃত শিলালিপির সন্ধানে। সঙ্গী প্রমোদরঞ্জন দাশগুপ্ত, কিরণকুমার রায় এবং পরিমল গোস্বামী। বিক্রমখোল থেকে ফেরার পথে পরিমল গোস্বামীর ওই উপলব্ধি। এ দিকে বিভূতিভূষণ তাঁর অভিযাত্রিক-এ ওই বিক্রমখোল-যাত্রার কথায় লিখছেন, ‘সেদিন দশমী তিথি। চমৎকার জ্যোৎস্না উঠলো সন্ধ্যার পরই। আমার মনে একটা মতলব জাগলো। এই সুন্দর জ্যোৎস্নারাত্রে সামনের সেই পাহাড়জঙ্গলের পথে একা যাবো। নতুবা ঠিক উপভোগ করতে পারা যাবে না। সন্ধ্যার পরেই সবাই রওনা হল। আমি বললুম হেঁটে আমি এক পা-ও যেতে পারবো না, পায়ে ব্যথা হয়েচে। আমি গোরুর গাড়িতে যাবো।’
এই সদর্থক তঞ্চকতাটুকু বিভূতিভূষণকেই চিনিয়ে দেয় নতুন করে। পথের পাঁচালী-র নায়ক যদি হয় অপু, এই মানুষটাই তবে বনপথের পাঁচালী-র নায়ক। যে পাঁচালির শেষে পরিমল গোস্বামীকে লিখতে হয়, ‘বড়ো আনন্দের বিষয় হল আমরা একই সঙ্গে বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অপুর সঙ্গ লাভ করেছি। বিভূতিবাবুই দু’ভাগ হয়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন, অর্থাৎ চারজনের বদলে আমরা প্রকৃতই ছিলাম পাঁচজন।’
বিক্রমখোল-অভিযানের ওই স্মৃতি ১৯৪৫-এ ‘প্রভাতী’ পত্রিকায় ‘পথের পাঁচালী’ নামে লিখেছিলেন পরিমল গোস্বামী। ১৯৫৫-য় তা সংকলিত হয় পথে পথে বইয়ে, ‘সম্বলপুরের অরণ্যপথে’ নামে, ১৯৭৪-এ বনপথের পাঁচালী বইয়ে পরিবর্ধিত আকারে। তারও প্রায় চল্লিশ বছর পরে পথে পথে আর বনপথের পাঁচালী দুটি বইই পুনঃপ্রকাশিত হল।
এই প্রায় সাত দশকে আদিগন্ত বদলে গিয়েছে বাঙালির ভ্রমণ। আদ্যন্ত পূর্বপরিকল্পিত সেই অবকাশযাপনে ‘হঠাৎ’ বলে কিছু নেই। ঘর হতে আর দু’পা ফেলারও দরকার হয় না, পারলে ঘরেই উঠে আসে নব নব ট্যুরিস্ট স্পট। নির্জনতা-য় একা হওয়াও আর সম্ভব নয়। আমূল বদলে যাওয়া এই ভ্রমণবিশ্বে পরিমল গোস্বামীর প্রায় হারিয়ে যাওয়া বইদুটি যেন সেই হারিয়ে যাওয়া পথে ভ্রমণের সুযোগ করে দিল। সম্বলপুর ছাড়া পথে পথে বইয়ে আছে দার্জিলিং, হাজারিবাগ, ডুয়ার্স, পশ্চিম হিমালয় আর কলকাতার চিনেপাড়া ভ্রমণ। বনপথের পাঁচালী এরই দুটি কাহিনির পরিবর্ধিত রূপ, ছোটদের জন্য।
এই ২০১৩-য় অনেকটাই বদলে গিয়েছে সেই ভ্রমণ-প্রকৃতি আর ভ্রমণ-পথের ছবি। কিন্তু মানুষ বদলেছে কি? মানুষের কথা বড় গভীর মমতায় লিখেছেন পরিমল গোস্বামী। জোর করে কোনও সামাজিক-অর্থনৈতিক তর্ক তুলতে চাননি। সেই দেখা, তাঁর তোলা সাদা-কালো ছবিরই মতো, সহজ, আন্তরিক: ‘আসতে আসতে দেড় মাইল পার হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম এক ভুটিয়া পল্লিতে।... অনেকগুলো ভুটিয়া মেয়ে-পুরুষ এগিয়ে এল আমাদের দেখতে। ওদের কয়েকজনের ছবি নিলাম, কিন্তু অনেক কষ্টে। তারা বারবার শীতলাবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, টাকা লাগবে না তো? এক ভুটিয়া যুবক হঠাৎ এসে শীতলাবাবুর পা জড়িয়ে ধরল। কারণ কিছুই নয়, ওদের আজ ছুটির দিন, অতএব সবাই একটু বেশি পরিমাণে মাতাল অবস্থায় ছিল।’
পরিমল গোস্বামীর তোলা ভ্রমণের ছবিগুলিও আছে দুটি বইয়ে। কিন্তু কোনও ব্যক্তি-পরিচয় নেই। অন্তত পথের সঙ্গীদের পরিচিতি দরকার ছিল। দরকার ছিল বিভূতিভূষণের অভিযাত্রিক-প্রসঙ্গটির টীকা। ঘোষিত প্রকাশন-সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও বাঙালির ভ্রমণ-ইতিহাসের এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই কী করে এত বছর পরে স্রেফ যা-ছিল-তাই হয়ে প্রকাশিত হয়ে যায় সেটা ভেবে দেখার মতো।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.