পুস্তক পরিচয় ১...
আপন মনের মাধুরী একটু বেশি
জিলট/ দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব জিসাস অব নাজারেথ, রেজা আসলান। হার্পার এলিমেন্ট, ৪৯৯.০০
খ্রিস্টাব্দ শুরু হয়েছে কি হয়নি। রোম-অধিকৃত গ্যালিলি-র (আজকের মানচিত্রে ইজরায়েল-এ) এক ছোট্ট গ্রাম নাজারেথ। বড় জোর শ’খানেক ইহুদি পরিবারের বাস। গ্রামে পাকা রাস্তা নেই, একটাই কুয়ো থেকে খাবার জল নিতে হয়। প্রায় সকলেই চাষি বা শ্রমিক। শিক্ষার নামগন্ধ নেই বললেই চলে। এতই নগণ্য যে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের আগের কোনও ইহুদি তথ্যসূত্রে নাজারেথ-এর নামের উল্লেখ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু এই অখ্যাত অবজ্ঞাত গ্রামের সঙ্গে যিশু-র নাম অঙ্গাঙ্গি। সংক্ষিপ্ত জীবনের পুরোটাই তাঁকে ‘নাজারেথ-এর যিশু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, শত্রুমিত্র সকলেই অন্তত এই একটি বিষয়ে একমত।
কিন্তু তাঁর জন্মস্থান কোনটা, নাজারেথ, না বেথলেহেম? ম্যাথু এবং লুক, দু’জনেই মাত্র একবার উল্লেখ করেছেন যে যিশুর জন্ম বেথলেহেম-এ। ‘ইহুদিদের রাজার জন্ম হয়েছে’ এমন গুজবে রাজা হেরড-এর নির্বিচার শিশুমেধের জেরে জোসেফ ও মেরির নাজারেথ-এ পালিয়ে যাওয়া কিংবা রোম সম্রাটের নির্দেশে জনগণনার জন্য তাঁদের বেথলেহেম-এ চলে আসা এর কোনওটাই ঐতিহাসিকরা আর বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। অথচ বেথলেহেম যে ইজরায়েলের আদি রাজা ডেভিড-এর শহর, ভবিষ্যদ্বাণীতে রয়েছে ডেভিড-এর বংশেই আসবেন সেই ‘মসিহা’। ফলে খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যিশুকে বেথলেহেম-এর সঙ্গে যুক্ত করা প্রথম শতাব্দীর গসপেল-লেখকদের কাছে নিশ্চয়ই জরুরি ছিল।
এমন উদাহরণ অজস্র আছে। সেগুলোই খুঁজেছেন রেজা আসলান তাঁর নতুন বইয়ে। আসলে তিনি নাজারেথ-এর যিশু আর যিশুখ্রিস্টকে আলাদা করতে চেয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য ইতিহাসের যিশুকে খুঁজে বার করা। বার করে দেখানো, গ্যালিলি-র এক অশিক্ষিত চাষি পরিবারের সন্তান যিশু ছিলেন রোম এবং রোমের সহযোগী ইহুদি অভিজাত ও পুরোহিততন্ত্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইহুদি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। শান্তির ললিত বাণী নয়, বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকারের কথাই আসলে প্রচার করেছিলেন তিনি। গাধার পিঠে চেপে জেরুসালেমের মন্দিরে ঢুকে সব তছনছ করার চেষ্টা সেই অভ্যুত্থানের প্রতীক। আসলানের মতে, যিশুকে যে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তার কারণও এই ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’। ইতিহাস বলে, ইহুদিদের ধূমায়িত ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত পুরোদস্তুর বিদ্রোহের আকার নেয়, এবং ৬৬ খ্রিস্টাব্দে জেরুসালেমে রোমের অধিকার বিলুপ্ত হয়। তবে প্রত্যাশিত স্বাধীনতার আয়ু ছিল মাত্র চার বছর, ৭০ খ্রিস্টাব্দেই জেরুসালেমকে ধুলোয় মিশিয়ে, যাবতীয় ইহুদিকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয় রোম। ইজরায়েলের মানুষের চেনা পৃথিবীটা ধ্বংস হল, কিন্তু ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল না।
এরই কাছাকাছি সময় খোদ রোমে বসে জন মার্ক নামে এক ইহুদি লিখতে শুরু করলেন যিশুকে নিয়ে প্রথম সুসমাচার। দেবভাষা হিব্রুতে নয়, যিশুর ভাষা আরামায়িক-এ নয়, বিজয়ীর ভাষা গ্রিক-এ। মার্ক, ম্যাথু, লুক, জন... একের পর এক তাঁদের গসপেল গড়ে তুলল অন্য এক চরিত্র ‘যিশুখ্রিস্ট’। বিপ্লবী থেকে শান্তির দূত। কেন এই পরিবর্তন?
পরিবর্তনটাই স্বাভাবিক। নাজারেথ-এর যিশু তো উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন ইহুদিদের। তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পরে, যখন ইহুদিদের সব বিপ্লব-প্রচেষ্টার সলিল সমাধি হয়েছে, রোম অপ্রতিরোধ্য, তখন খ্রিস্টধর্ম আর ইহুদিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যিশু-অনুগামীদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা অনেক কমেছে। আন্দোলনের ভরকেন্দ্র সরে গিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় গ্রিক-রোমক সংস্কৃতিকেন্দ্র, যেমন আলেকজান্দ্রিয়া, করিন্থ, দামাস্কাস, অ্যান্টিয়োক, এমনকী রোম-এ। মার্ক গসপেল লিখতে শুরু করছেন রোমের বিদ্বজ্জনদের জন্য। তাঁদের কাছে রোমের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের মুক্তিকামী বিপ্লবীর কথা তুলে ধরা সম্ভব ছিল কী? তাঁকে তাই লিখতে হয়েছে, জেরুসালেমের গ্রিক গভর্নর পন্টিয়াস পাইলেট নয়, যিশুর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিল ইহুদিরাই! ম্যাথু আর এক ধাপ এগিয়ে পাইলেটকে পুরোপুরি নির্দোষ করে দিয়েছেন, তাঁর ভাষ্যে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার দায় ঘাড়ে নিয়েছিল সমগ্র ইহুদিজাতি। লুক লিখেছেন, পাইলেট নাকি তিন তিন বার ইহুদিদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। অথচ, চূড়ান্ত ইহুদিবিদ্বেষী পন্টিয়াস পাইলেট-এর পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না।
এই ভাবে যিশুর চরিত্রে প্রায় শুরু থেকেই জমে ওঠা মিথ সরিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন রেজা আসলান। তাঁর গদ্য তরতর করে এগিয়ে যায়, সিনেমার কায়দায় কালে কালান্তরে আগুপিছু করে তিনি আম-পাঠকের কাছে যিশুর সময়টা জীবন্ত করে তোলেন। কিন্তু তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যিশুর জীবনের মাত্র দুটি ঘটনা সম্পর্কে আমরা নিঃসংশয় হতে পারি তিনি ইহুদি ছিলেন এবং খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এক ইহুদি গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, আর এই কারণে রোমক কর্তৃপক্ষ তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে। এর বাইরে তা হলে দুশো পাতার জীবনী লেখার উপকরণ কোথায়? সেই প্রথম তিনটি ‘সুসমাচার’ই মূলত আসলানের ভরসা, মুখবন্ধে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন, ‘মোস্ট এডুকেটেড গেস’-এর ভিত্তিতে তথ্য বাছা হয়েছে, এমনকী দু’বার তাঁকে বলতে হয়েছে এ নিয়ে তাঁর দীর্ঘ দুই দশকের গভীর গবেষণার কথা। গ্রহণ-বর্জনের কোনও নীতি তিনি স্পষ্ট করেননি। পাঠক দেখছেন, তাঁর ‘নির্মাণ’-এর সঙ্গে মেলে এমন আখ্যান তিনি কাজে লাগিয়েছেন, আর অন্য সব উড়িয়ে দিয়েছেন পরিকল্পিত পরিবর্তনের তকমা এঁটে।
ইতিহাসের যিশুকে এই ভাবে খোঁজার চেষ্টা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যিশুর ‘বিপ্লবী’ চরিত্রের কথাও এর আগে অনেকে আলোচনা করেছেন। রেজা আসলান জনপ্রিয় আখ্যান বুনতে গিয়ে বিতর্কিত অধিকাংশ তথ্যই বড় বেশি সরল করে উপস্থাপিত করেছেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে পড়তে চমৎকার লাগে, কিন্তু নাজারেথ-এর যিশুর নতুন জীবনী ভাবলেই সমস্যা।
ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এড়াতে রোম থেকে চলে যাচ্ছিলেন পিটার। পথে দেখা দিলেন যিশু। পিটার প্রশ্ন করলেন, ‘কুয়ো ওয়াদিস’ (কোথায় চলেছেন)? যিশু বললেন, ‘আমি রোমে যাচ্ছি দ্বিতীয় বার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার জন্য’। পিটার আত্মবিশ্বাস পেয়ে ফিরে গেলেন রোমে, প্রাণ দিলেন ক্রুশবিদ্ধ হয়েই। রেজা আসলান বার বার নাজারেথ-এর যিশুকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কুয়ো ওয়াদিস’? স্পষ্ট উত্তর পাননি। শেষে চেনা পথেই পা বাড়িয়ে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে যিশুর ছবি এঁকেছেন। জনপ্রিয়তা ছাড়া আর কোনও সাফল্য তাই তাঁর প্রাপ্য নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.