মাদক কাঁটা/৩
অন্ধকারের চাদরে
ঢাকা পাচার-তল্লাট

ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ের ঢাল যেখানে এসে সমতলে মিশেছে, তার অদূরে বাংলাদেশ লাগোয়া গঙ্গা-পদ্মায় রয়েছে ফরাক্কা ব্যারাজ ও ফিডার ক্যানাল। পাশেই ফরাক্কা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, অম্বুজা সিমেন্ট কারখানা, জিন্দালদের নদীবন্দর ও হরিণপার্ক। গঙ্গাপাড়ের মনোরম ওই পরিবেশে রয়েছে কেন্দ্রের বিলাসবহুল গেস্ট হাউস ‘গঙ্গাভবন’। নদীর অন্য পাড়ে মালদহ ও ভূতনির চর। ভৌগোলিক বিন্যাস ও প্রকৃতির অফুরান অবদানে গড়ে ওঠা মনোরম পরিবেশে গঙ্গাভবনের গালিচার মতো ঘাসের লনে বসেও বছর বারো আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বেশ চওড়া হয়ে উঠেছিল। শীত-বিকালে টেবিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে জনা চারেক সাংবাদিকের সামনেই তৎকালীন পুলিশ সুপার রাজেশ কুমারকে চিন্তিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “পাচার চলতে পারে না। দ্রুত বন্ধ করুন।”
ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ ও পাকুড়, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদহ মিলে দুই রাজ্যের চারটি জেলা ছাড়াও বাংলাদেশের সীমানা এসে মিশেছে ফরাক্কার ওই এলাকায়। ব্যারাজ লাগোয়া গঙ্গা-পদ্মার বুকে রয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ভূতনি-সহ গোটা তিনেক চর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পাচারের এ হেন আদর্শ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও সোনায় সোহাগা মিলিয়ে দিয়েছে। ফরাক্কার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছনোর মতো উন্নত রেলপথ ও জাতীয় সড়ক। রয়েছে নদীপথও। ফলে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে এলাকাটি যতটাই মনোরম, আন্তর্জাতিক পাচার মানচিত্রে ততটাই অন্ধকার জগৎ হিসাবে চিহ্নিত। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে শুনতে হয়েছিল, “মুর্শিদাবাদের কনে কর্তাদের কাছে শিক্ষকের থেকেও লোভনীয় পাত্র স্মাগলার অর্থাৎ সীমান্তের চোরা কারবারি।” তাই শুনে চোখ কপালে তুলে পুলিশ সুপারের উদ্দেশে বুদ্ধদেববাবুকে বলতে হয়েছিল, “এই অবস্থা চলতে পারে না। দ্রুত বন্ধ করুন।”
সেই নির্দেশ যে কোনও কাজেই লাগেনি, তা ভালই জানে ফরাক্কার মতো আন্তর্জাতিক চোরা কারবারের অন্যতম ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ লালগোলার রামনগর ঘাট। অন্ধকার জগতের ভাষায় চোরাচালানের ‘রুট’কে বলা হয় ‘ঘাট’। রামনগর থেকে বাংলাদেশের সীমানা মোটে আড়াই কিলোমিটার দূরে। রামনগরে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বড়সড় একটি স্থায়ী চৌকি থাকা সত্ত্বেও ওই ঘাট দিয়ে গরু থেকে হেরোইন সবই পাচার হয়। সিপিএমের লালগোলা জোনাল সম্পাদক জোহাক আলি ‘না জানলেও’ রামনগর গ্রাম জানে, ৭ জনের সিন্ডিকেট গড়ে ওই ঘাটের চোরাপাচারের দায়িত্ব সামলান স্থানীয় এক ব্যক্তি, যার রাজনৈতিক পরিচয় তিনি স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সদস্য। ওই সিন্ডিকেটের কেউ রয়েছে গরু পাচারের দায়িত্বে, কেউ হেরোইন পাচারে। কারও আবার হেরোইন তৈরি করার দায়িত্ব।
আগে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে লালগোলায় হেরোইন আসত। তারপর বাংলাদেশ হয়ে চলে যেত আন্তর্জাতিক বাজারে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “বছর দশেক থেকে পোস্ত চাষ করে লালগোলাতেই হেরোইন উৎপাদন করা হয়। তারপরেই লালগোলায় ব্যাপক ভাবে হেরোইনের নেশা ছড়িয়েছে।” সেই নেশার এমন ‘মাহাত্ম্য’ যে, হেরোইন কেনার টাকা যোগাড় করতে চোরের উপদ্রব বেড়েছে যথেষ্ট। নেশাসক্ত যুবক বাড়ির জিনিসপত্রও বিক্রি করে দিয়ে হেরোইন কেনে। এমনকী নেশার তাড়ায় হেরোইন কেনার টাকা জোটাতে লালগোলার অবিবাহিত যুবক জন্মনিয়ন্ত্রণের ‘অপারেশন’ করেছে, এমন ঘটনাও রয়েছে। হেরোইনের নেশায় শরীর ভেঙে গিয়ে ৩০ বছরের যুবককে দেখতে ৬০ বছরের বৃদ্ধ মনে হয়। সংসার ধ্বংস করার পর নেশাগ্রস্ত যুবকের অকালমৃত্যুর ঘটনার সাক্ষী লালগোলার অনেক পরিবারই।
বারো বছর আগে মুর্শিদাবাদ জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার রাজেশ কুমার যেমন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে পাচার বন্ধের কড়া নির্দেশ শুনেছিলেন, তেমনই গত ১৭ ডিসেম্বর সীমান্তের পাচার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে বর্তমান পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরকেও। ওই দিন রেজিনগরের তকিপুর হাই মাদ্রাসায় মিনি মহাকরণ সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই তিনি পুলিশ সুপারকে বলেন, “সীমান্তের পাচার বন্ধ করুন।” কিন্তু করবেন কী ভাবে? সীমান্ত এলাকায় আগের থেকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হলেও রামনগরের মতো কয়েকটি ‘ঘাট’ দিয়ে পাচার চলছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ। তাঁরা বলেন, “পাচারকারীদের সঙ্গে বিশেষ চুক্তি থাকে। সেই মতো রাতের অন্ধকারে এক-দু’ঘণ্টা নজরদারি তুলে নেওয়া হয়।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্তরক্ষী বাহিনীর রামনগর চৌকির এক অফিসার অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “ঝুট বাত। টহলদারি ঠিক মতোই চলছে।”
ওই গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের ওই অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিন্তু মিল পাওয়া গিয়েছে কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি)-এর কাছে পুলিশ সুপারের পাঠানো সীমান্ত এলাকার একটি গোপন রিপোর্টের। তাতে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় কিছু পুলিশকর্মী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের একাংশের হাতে মোটা টাকা রয়েছে।
হেরোইনের কারবার করে এমন পরিবারগুলি স্থানীয় আমজনতার ভাষায় ‘তারিবারি’, ‘খানবাড়ি’, ‘দারাবাড়ি’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। ওই সব ‘ডন’দের হেরোইন কারবারের জন্য প্রয়োজন কেরিয়ার। হেরোইনের কেরিয়ার হতে সাম্প্রতিক কালে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঝোঁক দেখা দিয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর। গল্পকার নীহারুল ইসলাম লালগোলার ভূমিপুত্র। তাঁর আক্ষেপ, “একটি স্কুলের এক শিক্ষকই হেরোইনের কারবারি
ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের কী ভাবে আটকানো যাবে!” হাইস্কুলের ওই প্রবীণ শিক্ষক একদা বাম পরিচালিত একটি পঞ্চায়েতের প্রধানও ছিলেন। পদ্মার অববাহিকার উর্বর জমিতে বেআইনি পোস্তচাষ করে লালগোলায় হেরোইন তৈরির তিনিই আদিস্রষ্টা।
কিন্তু সমস্যা হল, কে হেরোইনের কারবার করে, কে পাচার করে সে কথা ওই দিগড়ের বহু লোকই জানেন। জানে না কেবল পুলিশ-প্রশাসন! যে তল্লাট অন্ধকার বলে মনে হয়, তা আসলে বেশ প্রকাশ্য দিবালোকেই চাক্ষুষ করা যায়। কিন্তু তবু অন্ধকারের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।

(শেষ)

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.