বছর বারোর ব্যবধান। আর ওই সময়য়ের মধ্যেই একজন রাজমিস্ত্রীর সামান্য জোগাড়ে হয়ে গেলেন কোটিপতি! পেটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিদ্যেটুকুও নেই। সেই তিনিই এখন বহুজাতিক মোটরবাইক সংস্থার কোটি টাকার ঝাঁ চকচকে ‘শোরুম’-এর মালিক। মাত্র বারো বছরের ‘অদম্য অধ্যবসায়ে’ সব অসম্ভবও সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও লালগোলার লোক তাঁকে আড়ালে আবডালে ‘হেরোইন ডন’ বলেই ডাকেন। নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন তিনি নাকি টাকার ‘বিছানায়’ শুয়ে থাকেন।
বছর দুয়েক আগে সেই ‘ডন’ লালগোলার একটি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকেই চড় মারতে গিয়েছিলেন। তারপরেও তাঁর টিকি ছুঁতে পারেনি পুলিশ। উল্টে স্থানীয় পুলিশ মহলে তাঁর খাতির আরও বেড়েছে বই কমেনি। আর খাতির থাকবে নাই বা কেন? লালগোলায় পুলিশের আয়োজন করা মাদক বিরোধী শিবিরের মুখ ‘উজ্জ্বল’ হয় তাঁর তৈরি করে দেওয়া বিশাল তোরণে। আর তাই হেরোইন পাচারের অভিযোগে বছর দুয়েকের মধ্যে লালগোলা থেকে ধৃত আড়াইশো জনের দীর্ঘ তালিকায় তাঁর নাম ঠাঁই পায়নি।
কিন্তু সেই তালিকায় আরও যাঁদের নাম রয়েছে তাঁরাও খুব একটা কম যান না। সিপিএমের লালগোলা লোকাল কমিটির সদস্য তথা বাহাদুরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধানের স্বামী শ্রীকান্ত বিশ্বাস, লালগোলার প্রাক্তন উপ-প্রধান আরএসপি-র মেহেরুল খান, ময়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য কংগ্রেসের কলিমুদ্দিন শেখ বিল্লু, ‘হেরোইন কিং’ হিসাবে পরিচিত লালগোলার বিলবোরা কোবরা গ্রাম পঞ্চায়েতের আটরশিয়া গ্রামের ইলিয়াস শেখ— তালিকাটা ক্রমেই দীর্ঘ হয়।
ওঁরা সবাই এখন বিচারাধীন জেলবন্দি। তবে ধরা না পড়লেও পুলিশের নজরে রয়েছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির এক কংগ্রেস সদস্যও। পুলিশি ‘নজর’ এড়াতে কংগ্রেসের টিকিটে জেতা পঞ্চায়েত সমিতির ওই সদস্য এখন তৃণমূলের দিকে এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন বলেই খবর।
হেরোইনের কারবারিদের অর্জন করা কোটি কোটি টাকার সৌজন্যে লালগোলা ও লাগোয়া রঘুনাথগঞ্জ মিলিয়ে দু’টি থানা এলাকায় গজিয়ে উঠেছে শতাধিক ইটভাটা, ডজন খানেক বিলাস বহুল হোটেল ও কয়েক ডজন করাত কল। হেরোইন কারবারিদের অনেকেই মোটর বাইক ও চার চাকার গাড়ির টায়ারের বহুজাতিক কোম্পানির জবরদস্ত ডিলার। মুর্শিদাবাদ জেলার এক গোয়েন্দা কর্তা কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, “হোটেল, শোরুম, ইটভাটা, করাতকল, অথবা জমি-ফ্ল্যাট এ সবই আসলে হেরোইন পাচারে আয় করা কালো টাকা সাদা করার কল।”
কিন্তু শুধু কালো টাকা সাদা করলেই তো চলবে না। সীমান্তের কালো ব্যবসার ওই কারবারিরাও সদা সতর্ক থাকেন যাতে তাঁদের ভাবমূর্তিতে কালো দাগ না পড়ে। ফলে ভাবমূর্তি সাদা রাখতে ‘সমাজসেবার’ পাশাপাশি তাঁরা যোগ দেন রাজনৈতিক দল, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোট ও নির্বাচিত জনপ্রতিধি হওয়ার প্রতিযোগিতায়। রাজনৈতিক দলকে ‘তুষ্ট’ করার পর ময়া, চাটাইডুবি, চামাপাড়া, লতিবেরপাড়া, কালমেঘা, আটরসিয়া, রামনগর, শিশারমজানপুর-সহ লালগালার ১৫-২০টি গ্রামে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার পর্বে শুরু হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালার প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সীমান্তের ওই গ্রাম গুলিতে গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি সদস্য পদে নির্বাচিত হতে খুব কম করে হলেও ৭ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঢালেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী।
রাজনৈতিক নেতারা হেরোইন কারবারিদের মদত দেওয়ার অভিযোগ অবশ্য মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ঝেড়ে ফেলেন। সিপিএমের লালগোলা লোকাল কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী শ্রীকান্ত বিশ্বাস একসময় ট্রেনে বাদাম ফেরি করে সংসার চালালেও আজ তিনি কেতাদুরস্ত হোটেল ও ইটভাটার মালিক। তবুও গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত শ্রীকান্তের হেরোইন কারবার সর্ম্পকে সিপিএমের লালগোলা জোনাল কমিটির সম্পাদক জোহাক আলি নাকি কিছুই জানতেন না! জোহাক বলেন, “ব্যবসাটি তো আসলে গোপনে হয়। তাই পুলিশ গ্রেফতার করার আগে হেরোইন কারবারে শ্রীকান্তের যুক্ত থাকার কথা জানতাম না। জানার পরে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।” হাসতে হাসতেই গ্রামের মানুষ বলেন, “বহিষ্কার করা ছাড়া আর তো কোনও উপায়ও ছিল না।”
কংগ্রেস অবশ্য সে পথও মাড়ায় না। ময়া গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের করিম শেখ বিল্লু হেরোইন কারবারে অভিযুক্ত হয়ে এখন জেলে। কংগ্রেসের লালবাগ মহকুমা সভাপতি তথা লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাপতি সুজাউদ্দিন বলেন, “বিশ্বাস করুন, হেরোইন পাচারে আমরা মদত দিই না। খোঁজ নিলে দেখবেন কেউ ধরা পড়লে তার হয়ে পুলিশের কাছে তদ্বিরও করি না। আমরাও চাই ওই পাপ ব্যবসায় জড়িতদের কড়া শাস্তি হোক।” তাই যদি হবে তাহলে পুলিশের নজর-তালিকায় থাকা কংগ্রেসের একজন লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যপদ আলো করে আছেন কী করে? সুজাউদ্দিন বলেন, “ওই সদস্য হেরোইনের কারবার করেন কিনা আমার জানা নেই।” তবে এ কথা পুলিশের পাশাপাশি বিলক্ষণ জানেন তামাম গ্রামবাসী।
হেরোইন পাচারের অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এখন জেলে রয়েছেন প্রাক্তন উপ-প্রধান আরএসপি-র মেহেরুল খান। পুলিশের খাতায় তাঁর পরিচয় আর্ন্তজাতিক হেরোইন পাচারচক্রের বড়সড় চাঁই। আরএসপি-র মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পঞ্চায়েত স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য দলীয় টিকিট দেওয়ার আগে প্রার্থী সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হয় না। আর সেই কারণেই পরবর্তীতে জনমানসে দলের ভাবমূর্তি খুব খারাপ হয়ে যায়। তার দায় অবশ্য আরএসপি-সহ আরও অনেক দলেরই। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।” মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরের মতে, “আফগানিস্থান, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে হয়ে হেরোইন আসে লালগোলায়। তারপর বাংলাদেশে হয়ে চলে যাচ্ছে মায়নামার হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে।” তিন দশক ধরে পাচারের ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসাবে পরিচিত লালগোলাতে কীভাবে তৈরি হচ্ছে হেরোইন? আর সেই ‘পাউডার’ (পড়ুন হেরোইন) হাত বদল হয়ে কীভাবে পৌঁছে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে? পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে মিলেছে রোমহর্ষক এ রকম বেশ কিছু তথ্য। |