কয়েক বছর আগের কথা। শীতে কাহিল ডিসেম্বরের কোনও এক অলস দুপুর। চোখের সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত পদ্মার চর। হাড় কাঁপানো শীত আর কুয়াশায় মোড়া চরের এক প্রান্তে বয়ে চলছে মরা পদ্মার একটি শাখা নদী। সেখানে হাঁটু জলের স্রোত। তিরতিরে সেই স্রোতের ওপারে লালগোলা থানার উত্তর লতিবেরপাড়া। ওই জলটুকু পেরোলেই কয়েক ধাপ পর লতিবেরপাড়ায় নিজেদের বাড়ি পৌঁছে যাবে ছোট্ট দুই ভাইবোন। বোন ক্লাস থ্রি, ভাই ফোর। মাথায় ঘাসের বোঝা। হতদরিদ্র পরিবারের পোষ্য গরু-ছাগলের জন্য চর থেকে ঘাস নিয়ে বাড়ি ফিরছে দুই খুদে পড়ুয়া। এমন সময় ভূত দেখার মতো হাজির বিএসএফের দুই জওয়ান।
ঘাসের বোঝার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল হেরোইনের প্যাকেট।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বর্ডার আউট পোস্টে (বিওপি) ছুটলেন ধৃত দুই শিশু হতদরিদ্র মা। সঙ্গে স্থানীয় তৎকালীন পঞ্চায়েতে প্রধান। জওয়ানদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা। তিনি জানান, ১৫০ টাকার জন্য ব্যাটাবিটিকে দিয়ে ওই কাজ করিয়েছেন। মালিকের নাম? সে প্রশ্নের জবাব এল, “নাম করতে বলবেন না হুজুর। তাহলে খুন হয়ে যাব।” জওয়ানেরা জানেন, সব ক’টি কথাই সত্যি। অভাবও সত্যি। ভয়ও সত্যি। তাই দয়াপরবশ জওয়ানরা ছেড়ে দিলেন ওই শিশুদের। |
একই ভাবে বছর তিনেক আগে লালগোলা বাসস্টপের ঘটনা। স্থানীয় রহমতুল্লা হাইমাদ্রাসার ক্লাস ফাইভের এক ছাত্রীর স্কুলব্যাগ থেকে পুলিশ উদ্ধার করে ৯০০ গ্রাম হেরোইন। পুলিশের মতে, ওই হেরোইনের আন্তর্জাতিক মূল্য প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা। বিরামপুর গ্রাম থেকে স্কুলের পোশাক পরে টমটমে করে রহমতুল্লা হাইমাদ্রাসার দিকে রওনা দিয়েছিল সে। পথে লালগোলা বাসস্টপের কাছে নেতাজি মোড়ে ধরা পড়ে যায় হতদরিদ্র পরিবারের ওই নাবালিকা। লোকজন জড়ো হয়ে যায়। জনতার অনুরোধে পুলিশও ওই যাত্রায় জওয়ানদের মতো ছাত্রীটিকে রেহাই দেয়। খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওই ছাত্রীটিও হেরোইন পাচারচক্রের পাণ্ডাদের নাম বলতে পারেনি।
হেরোইন পাচারের ‘কেরিয়ার’-এর কাজে একদা যুক্ত থাকা লতিবেরপাড়া ও বিরামপুরের ওই ৩ নাবালিকার ধরা পড়া ও মুক্তি পাওয়ার কাহিনি লালগোলার আমজনতার মুখে এখন স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এ বার হেরোইন পাচারের অভিযোগে মঙ্গলবার পুলিশ পাকড়াও করেছে দুই ছাত্রকে। তাঁরা লালগোলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের পদার্থবিদ্যায় অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কামারুজ্জামান শেখ জামাল ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মানজারুল ইসলাম। লালগোলার সেখালিপুর মোড়ে বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া জঙ্গিপুর-লালগোলা রাজ্য সড়কের উপর থেকে ধৃত ওই দুই ছাত্রের কাছ থেকে ৫৫ লক্ষ টাকার হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। বিরামপুর ও লতিবেরপাড়ার ৩ নাবালক-নাবালিকার মতো ভাগ্য অবশ্য প্রসন্ন হয়নি কামারুজ্জামান ও মানজারুলের। তাঁরা যে চক্রের সঙ্গে যুক্ত, তার হদিস পেতে আদালতের কাছে লালগোলার ওসি রবি মালাকার ধৃত কামারুজ্জামানের পুলিশ হেফাজত চেয়েছেন। আবেদনে সাড়া মিলেছে। আদালতের নির্দেশে মানজারুল রয়েছেন জেল হেফাজতে ও কামারুজ্জামান পুলিশ হেফাজতে।
কোন কারণে হেরোইন পাচারের কেরিয়ারের মতো চূড়ান্ত অপরাধমূলক ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্হিত কাজে তৃতীয় শ্রেণির শিশুছাত্রী থেকে অনার্সের তরুণ ছাত্র পর্যন্ত অনেকেই যুক্ত হয়ে পড়ছে?
হেরোইনের নেশা ও পাচার থেকে বর্তমান প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রাখতে লালগোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদ্য নির্বাচিত প্রধান অজয় ঘোষ বেসরকারি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে এক দশক ধরে লড়াই করছেন। অজয়বাবু বলেন, “মৌমাছি যেমন মধুর লোভে মৌচাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একই রকম ভাবে কাঁচা পয়সার লোভ সামলাতে না পেরে হেরোইন পাচারের কেরিয়ারের ফাঁদে পা গলিয়ে দিচ্ছে শিক্ষিত নতুন প্রজন্মও।” অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ব্যাখা, “একশো দিনের কাজে সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে মিলবে ১৫১ টাকা, সারাদিন বিড়ি বেঁধে মজুরি তার চেয়েও কম। অন্য দিকে হেরোইন পাচারের কেরিয়ার হলে কয়েক ঘণ্টাতেই জুটবে কয়েক হাজার টাকা।” তাই বলে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও? অজয় বলেন, “পরিচিত হয়ে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এড়াতে পাচারকারীররা ঘন ঘন কেরিয়ার পাল্টায়। ফলে আমআদমি থেকে পাচারচক্রর পাণ্ডারা এখন লোভের হাত বাড়িয়েছে স্কুল কলেজের দিকে।”
মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরের বক্তব্যেও ওই কথার সমর্থন মিলেছে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে গত দু’বছরে মুর্শিদাবাদ জেলায় হেরোইন পাচারের ২৫৮টি ঘটনায় ৩১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের কাছ থেকে হেরোইন ও হেরোইন তৈরির মূল উপকরণ পোস্ত ফলের আঠা মিলিয়ে মোট ২১৫ কেজি নেশাদ্রব্য বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। পুলিশের মতো যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ২১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়াও হেরোইন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ২৭ কুইন্টাল রাসায়নিক উপকরণও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। পুলিশ সুপার বলেন, “ধৃত ও বাজেয়াপ্তের শতকরা ৮৫ ভাগই লালগোলার। ধৃতদের মধ্যে রয়েছে লালগোলার ১৭ জন মহিলা কেরিয়ার। ধরপাকড়ের অভিজ্ঞতা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে পাচারচক্রের পাণ্ডাদের চোখ পড়েছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের দিকে।” স্কুল-কলেজের পড়ুয়া ধরতে হায়েনার মতো থাবা বাড়ানো পাচারচক্রের সেই পাণ্ডা কারা? তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিচয়ই বা কেমন? পুলিশ সম্প্রতি বেশ কিছু রাঘববোয়ালকে গ্রেফতার করেছে। জেরা করে তাদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে অনেক অজানা রহস্যের খবর। |