পরিচয়পত্র না দেখিয়েই মিলছে ঘর ভাড়া |
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় • তারাপীঠ |
স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তাঁরা তারাপীঠের একটি লজে উঠেছিলেন। পরের দিন সকালেই লজের ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছিল ওই মাঝবয়সী মহিলার গলাকাটা দেহ। সেই ‘স্বামী’ যথারীতি বেপাত্তা। লজ কর্তৃপক্ষ ওই দু’জনের পরিচয়পত্র না দেখেই ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। তাঁরা যে ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেটিও ছিল ভুয়ো। পুলিশের দাবি, লজ কর্তৃপক্ষের এই গাফলতির জেরেই দু’জনের কারও পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। যার নিট ফল— ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনার আজও কিনারা করা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ওই ঘটনার পরেও তারাপীঠের হোটেল-লজ-গেস্ট হাউসগুলির একটি অংশ এখনও শিক্ষা নেয়নি। অধিকাংশ লজের ক্ষেত্রেই শুধু ‘খদ্দের’ পেলেই হল। উপযুক্ত পরিচয়পত্র দেখা হয় না। এমনকী রেজিস্টারেও সঠিক পরিচয়-ঠিকানা নেওয়া হয় না। তা হলে কি দেশের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র তারাপীঠে পুলিশ-প্রশাসনের নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই চলছে বিভিন্ন হোটেল-লজ-গেস্ট হাউস? বৃহস্পতিবার স্থানীয় আশ্রমের অতিথি নিবাসে একই পরিবারের ছ’ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে প্রশ্নটা ফের উঠতে শুরু করেছে। কেননা দেখা গিয়েছে, ওই আশ্রমের ক্ষেত্রেও মিশ্র পরিবারকে ঘর ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক করে তাঁদের পরিচয়পত্র দেখা হয়নি। এমনকী, রেজিস্টারে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা বা যোগাযোগের জন্য কোনও ফোন নম্বরও ছিল না। বাসিন্দারা মনে করছেন, এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তারাপীঠকে ঘিরে উত্তরোত্তর হোটেল-লজ ব্যবসা বাড়ছে। বাড়ছে পুলিশ-প্রশাসনের নিয়ম ও নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখানোর খেলাও। |
মানবে কে? ছবি: অনির্বাণ সেন। |
আশ্রমের ঘটনার পরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন লজ মালিক মনে করছেন, তারাপীঠে এ ধরনের ঘটনা লজ ব্যবসায়ীদের ব্যবসার উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। তাঁদের অভিযোগ, “একশ্রেণির লজ ব্যবসায়ী পরিচয়পত্র না দেখেই ঘর ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন। এতে সাময়িক ভাবে হয়তো ওই তাঁরা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু আখেরে ক্ষতি হচ্ছে গোটা ব্যবসার। কেন না এলাকার কোনও লজে বা আশ্রমে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তার দায় সবার উপরেই বর্তাবে।” তাঁদের অভিমত, পুলিশ-প্রশাসনের নির্দেশ মেনে ব্যবসা করলে এমন অবাঞ্ছিত ঝুটঝামেলা সহজেই এড়ানো যায়। তারাপীঠের অন্যতম লজ মালিক তথা বীরভূম জেলা পরিষদের প্রাক্তন সহ-সভাধিপতি নিতাই মাল যদিও বলছেন, “২০১১ সালের ওই ঘটনার পর থেকে তারাপীঠে উপযুক্ত পরিচয়পত্র ছাড়া ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না।” তাঁর সুরেই তারাপীঠ লজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তথা তৃণমূলের রামপুরহাট ২ ব্লক সভাপতি সুকুমার মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “সরকারি নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে আমাদের সংগঠন সদা সতর্ক। কোনও লজ মালিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে সংগঠনে রাখা হবে না।” অন্য দিকে, সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি দেবীপ্রসাদ মণ্ডল বলেন, “তারাপীঠে এখন প্রায় ৪০০টি লজ রয়েছে। আশ্রম বা অন্য সংস্থা লজ মালিক সংগঠনের মধ্যে পড়ে না। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান যদি সরকারি নির্দেশ মেনে না চলে, তা হলে তার দায় আমাদের নয়।”
কিন্তু ফব নেতা নিতাই মাল বা তৃণমূল নেতা সুকুমার মুখোপাধ্যায় যাই বলুন না কেন, তারাপীঠ থেকে মুণ্ডমালিনীতলা যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দালাল বা লজ কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই অন্য কথা কানে আসে। “আপনি কড়ি ফেলুন, যে কোনও ঘর পেয়ে যাবেন। পরিচয়পত্র লাগবে না।” কোনও রাখঢাক না রেখেই বললেন এমনই এক দালাল। তারাপীঠ ফাঁড়িতে কর্মরত পুলিশের এক আধিকারিকের আবার অভিজ্ঞতা, “ওই সব লজ মালিকদের একাধিকবার এ ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি! মালিকেরা তো আর লজে থাকেন না। লজের ম্যানেজার-কর্মীরা যে ভাবে মনে করেন, সেই ভাবেই ঘর ভাড়া দেন।” এ ভাবে সহজেই পরিচয় গোপন করে থাকার সুযোগ পেয়ে অপরাধীদের আত্মগোপন করে থাকার প্রিয় জায়গা হিসেবে বারবার তারাপীঠের নাম উঠে এসেছে। অতীতে তার নজিরও রয়েছে। জেলা পুলিশের এক প্রাক্তন কর্তাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “বহু অপরাধমূলক ঘটনায় যুক্ত দুষ্কৃতীরা তারাপীঠে লজে আত্মগোপন করে থাকার পরে ধরা পড়েছে। কোচবিহারের মদনমোহন মূর্তি চুরিতে যুক্ত এক জন ধরা পড়েছিল। সজল বারুই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত এক জনও এখান থেকেই ধরা পড়ে। এমনকী, দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলার এক ১০ বছরের বালককে অপহরণ করে নিয়ে এসে অপহরণকারীরা তারাপীঠের একটি হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন।” এমন সব নজির থাকার পরেও একাংশ যে সতর্ক হচ্ছেন না, তা বৃহস্পতিবারের ঘটনার পরে ফের প্রমাণ হল।
এ দিন দুপুরে অবশ্য ওই আশ্রমে গিয়ে দেখা গেল আশ্রম কর্তৃপক্ষ অতিথি নিবাসের ঘর ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা নিয়েছেন। হুগলির ডানকুনি থেকে মা তারার দর্শনে এসেছিলেন উত্তম ঘোষ। কিন্তু সঙ্গে উপযুক্ত পরিচয়পত্র আনেননি। অতিথি নিবাসের ঘর ভাড়া পেতে দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁকে ঘর দেননি আশ্রম কর্তৃপক্ষ। একই জিনিস ঘটল কলকাতার বালিগঞ্জ থেকে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আসা সঞ্জয় দাসের ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে যে লজে মহিলার দেহ উদ্ধার হয়েছিল, এ দিন সেখানে গিয়ে অবশ্য দেখা গেল পরিচয়পত্র দেখেই কর্তৃপক্ষ ঘর ভাড়া দিচ্ছেন। লজের কর্মীরা বলছেন, “ওই ঘটনায় আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। মালিককে অনেক আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল তার পর থেকে সবার ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশ মেনেই ঘর ভাড়া দেওয়া হয়। বাকিদেরও ওই নির্দেশ মেনে চলার পরামর্শ দেব।” দুপুরেই কলকাতার গড়িয়া থেকে তারাপীঠের একটি লজে উঠেছেন নন্দ সাউ, সত্যব্রত রায়-রা। তাঁরাও বলছেন, “তারাপীঠ এখন আন্তর্জাতিক তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধরনের মানুষের এখানে সমাগম ঘটে। যাঁরা আসছেন, তাঁদের প্রত্যেকের অবশ্যই নিজেদের পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত।”
এ দিকে, এসডিপিও (রামপুরহাট) কোটেশ্বর রাও বলেন, “তারাপীঠ লজ মালিক, আশ্রম কর্তৃপক্ষ সবার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খুব শীঘ্রই আলোচনায় বসা হবে। সেখানে প্রত্যেকেই যাতে নিয়ম মেনে ঘর ভাড়া দেন, তার কড়া নির্দেশ দেওয়া হবে।” অন্য দিকে, রামপুরহাটের মহকুমাশাসক রত্নেশ্বর রায় বলেন, “উপযুক্ত পরিচয়পত্র ছাড়া লজ বা আশ্রমে কাউকেই রাখা যাবে না। বিশেষ কোনও ক্ষেত্রে স্থানীয় থানাকে জানিয়েই কাউকে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে প্রশাসন প্রয়োজনে কড়া পদক্ষেপ করতে দ্বিধা করবে না।” |