নিয়মিত ক্লাসে হাজিরার দরকার নেই। চাকরি করতে-করতে বা চাকরি পাওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে-নিতেও পড়াশোনা করা যায়। নিয়মের বাঁধন আলগা বলেই দূরশিক্ষায় পড়ুয়াদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে শুধু নয়, গুণগত মানেও দাগ কাটছেন পড়ুয়ারা।
এই পরিস্থিতিতে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে দূরশিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সংস্থার প্রাক্তন যুগ্মসচিব (পূর্বাঞ্চল) রত্নাবলি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দূরশিক্ষার মানোন্নয়নে বেশ কিছু ভাবনা-চিন্তা চলছে। ধীরে-ধীরে সেগুলি কার্যকর করা হবে।”
আগে দূরশিক্ষার নজরদারির দায়িত্বে ছিল ‘ডিসট্যান্স এডুকেশন কাউন্সিল’। যার প্রধান ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইগনু) উপাচার্য। দূরশিক্ষার একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে থাকায়, আপত্তি ছিল অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির। এই নিয়ে বহু বার ইউজিসি-র কাছে আবেদনও জানায় তারা। বহু আলাপ-আলোচনার শেষে চলতি শিক্ষাবর্ষে ‘ডিসট্যান্স এডুকেশন ব্যুরো’র (ডিএবি) মাধ্যমে দূরশিক্ষার দায়িত্ব নেয় ইউজিসি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক কর্তার কথায়, ইউজিসি মনে করে নিয়মিত পঠন-পাঠন হোক বা দূরশিক্ষা, উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এ বার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে পাঠ্যক্রম তৈরি-সহ গোটা ব্যবস্থায় নজরদারি আরও বাড়ানো হবে। আগে ইউজিসি-র যে নির্দেশ ইগনু মারফত আসত, তা এ বার ডিএবি-র মাধ্যমে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছবে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “ইউজিসি আমাদের চিঠি পাঠিয়েছে। এ বার থেকে দূরশিক্ষার নিয়মাবলি ঠিক করবে ডিএবি। নতুন স্টাডি সেন্টার বা নতুন বিষয় চালু করতে গেলেও ডিএবি থেকেই অনুমোদন নিতে হবে।”
বস্তুত, দূরশিক্ষা যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে দিন-দিন, তাতে এই নিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মনে করছে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে সুযোগ না-পেলে লোকজন দূরশিক্ষায় পড়তে যেতেন। সেখানে এখন দূরশিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রিও মিলছে। আবার যাঁরা সরকারি চাকরিকে ‘পাখির চোখ’ করেছেন, তাঁরা দূরশিক্ষার মাধ্যমে কম পরিশ্রমে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়িয়ে নিচ্ছেন। বাড়তি শ্রম বরাদ্দ করছেন নিজের পছন্দের বিষয় বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। দূরশিক্ষায় নতুন-নতুন বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির ফলেও ছাত্র বাড়ছে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগের কর্তা জয়ন্ত কুণ্ডু জানান, নতুন ‘ডায়েটিক অ্যান্ড কমিউনিটি নিউট্রিশন ম্যানেজমেন্ট’ যথেষ্ট জনপ্রিয়।
দূরশিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে নতুন পরিকল্পনাও নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগের কর্তা জুরানকৃষ্ণ সরখেল জানান, পড়ুয়াদের আগ্রহী করতে পাঠ্যক্রমে বদল আনা হয়েছে। ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্নের বদলে অনেকটাই ‘অবজেকটিভ’ হয়েছে প্রশ্নের ধরন। চালু হয়েছে অর্ন্তবর্তী মূল্যায়ন। তা ছাড়া ‘ই-লার্নিং’-এর চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। ‘পার্সোনাল কন্ট্যাক্ট প্রোগ্রাম’ জোরদার করা হচ্ছে। এক কথায় আরও যুগোপযোগী ও প্রায়োগিক করা হচ্ছে দূরশিক্ষাকে।
দূরশিক্ষার পড়ুয়ারা পাল্লা দিচ্ছেন নিয়মিত পাঠ্যক্রমের পড়ুয়াদের সঙ্গে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগের অন্যতম কর্তা দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের মতে, “শিক্ষাবিজ্ঞানে দূরশিক্ষার ফল নিয়মিত পাঠ্যক্রমের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতে দূরশিক্ষার ফলও ভাল হয়েছে।”
দূরশিক্ষার পড়ুয়ারা দাগ কাটছেন নেট, সেট, গেট-এও। গত শিক্ষাবর্ষে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষার দুই ছাত্র কেমিস্ট্রিতে নেট এবং তিন জন গেট পেয়েছেন। ভূগোলে চার জন এবং প্রাণিবিজ্ঞানে এক জন নেট পেয়েছেন, পিএইচডিও করছেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনেও দূরশিক্ষার পড়ুয়ারা ভাল ফল করছেন। উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবড়ার অপু মণ্ডল এবং গোবরডাঙার অভিজিৎ সিংহ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাশ করেছিলেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষকতা করছেন তাঁরা।
উচ্চশিক্ষায় নতুন গতি এনে দিয়েছে দূরশিক্ষা। এ বার ইউজিসি-র নিয়ন্ত্রণ তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে, এমনটাই আশা। |