|
|
|
|
অন্য রকম ‘স্যার’ হয়েও খুশি প্রাক্তন মুখ্যসচিব |
দেবাশিস ভট্টাচার্য • বারাণসী |
‘‘স্টুডেন্টস্, টুডে উই উইল ডিসকাস সিম্পল হারমোনিক মোশন.....’’।
ডাস্টার দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড মুছতে মুছতে শুরু করলেন তিনি। পড়ুয়ারাও খাতা-কলম নিয়ে প্রস্তুত।
একাদশ শ্রেণির পদার্থবিদ্যার ক্লাস। শিক্ষক অর্ধেন্দু সেন।
কোনও পেশাদার শিক্ষকের ক্ষেত্রে এমন তথ্য নিতান্তই মামুলি। তবে রাজ্যের একজন মুখ্যসচিব যখন অবসর নেওয়ার পরে আবেদন করে স্কুলে পড়াতে চলে যান, তখন তা নজর কাড়ে। যেমনটি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেনের বেলায়। চাকরির মেয়াদ ফুরোলে শীর্ষ আমলারা অনেকেই এখন রাজনীতিতে আসছেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মন্ত্রিসভাতেই প্রাক্তন আইএএস-আইপিএসের সংখ্যা কম নয়। আমলাদের অনেকে আবার অবসরের পরে বিভিন্ন কমিটি বা কমিশনেও যোগ দেন। কিন্তু সেই সীমিত পরিসরের বাইরেও যে শিক্ষকতার মতো কাজে অবসর জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন অর্ধেন্দুবাবু। চলতি হাওয়ার নিরিখে তাই তাঁকে কিছুটা বিচিত্রগামী বলাই চলে।
স্কুলের জন্য পদার্থবিদ্যার শিক্ষক চাই খবরটা কানে আসতেই তাঁর মন বলেছিল, যাই। গুড়গাঁওয়ের বাড়ি থেকে সোজা ই-মেল বারাণসীর কৃষ্ণমূর্তি ফাউন্ডেশনে। পরের পর্বে বিশেষ দেরি হয়নি। মাস দুয়েক আগে তিনি যোগ দিয়েছেন বারাণসীর রাজঘাটে কৃষ্ণমূর্তি ফাউন্ডেশনের বেসান্ত স্কুলে। দায়িত্ব একাদশ শ্রেণিতে পদার্থবিদ্যা পড়ানো।
অর্ধেন্দু সেন |
দিল্লি নয়, কলকাতা নয়। দুয়ের মধ্যবর্তী বিন্দু বারাণসীতে নিস্তরঙ্গ গঙ্গার তীরে কোলাহলহীন এই আশ্রমিক পরিবেশ তাঁর এখনকার ঠিকানা। এত দিনের কর্মব্যস্ত দিনলিপির বিপরীত ছবি। সকাল সাড়ে ৮টায় প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার পরে সারা দিনে দু’টি মাত্র ক্লাস। ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা বড়জোর কুড়ি। ক্লাসের ছুটি হলে আবার একা হয়ে যাওয়া।
কেন বেছে নিলেন এই কাজ? অন্য রকম কর্মজীবন কাটিয়ে এসে কি পারছেন এ ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে? কোথাও ছন্দপতন হয় না? “বিশ্বাস করুন, হয় না। বেশ ভাল লাগে এই নির্জনতা। আমাদের গুড়গাঁওয়ের বাড়িটাও তো খুব নিরিবিলি এলাকায়। আমি অভ্যস্ত।” সকালের হিমেল হাওয়ায় রাজঘাটের গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে জানালেন অর্ধেন্দু। একটু আগেই শেষ হয়েছে দৈনন্দিন প্রার্থনার পর্ব। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সেখানে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। অর্ধেন্দুবাবু বলে রেখেছিলেন, মঙ্গলবার বেলা ১২টার আগে তাঁর ক্লাস নেই। সেই ফাঁকে কথা হবে।
প্রার্থনা হল থেকে বেরিয়ে আশ্রম ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গাতীরে। চারপাশ সুনসান। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব বলতে লাগলেন, “এখানে আসার সিদ্ধান্ত অনেকটাই আকস্মিক। পড়াতে আসার পিছনে কোনও আদর্শের তাড়না বা বড় ভাবনাচিন্তা ছিল, বলব না। কোনও দিন এই পেশা নিয়ে ভাবিওনি। আসলে আমাকে এ দিকে টেনে আনার মূলে হিগ্স-বোসন তত্ত্ব।” কী রকম?
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্র অর্ধেন্দুবাবু জানালেন, ২০১০-এর মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল হিগ্স-বোসন তত্ত্ব এবং বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান সম্পর্কে বাংলায় স্কুল-পড়ুয়াদের জন্য কিছু লেখা। “কিন্তু চেষ্টা করে দেখলাম, আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। স্কুলপড়ুয়াদের জন্য বিষয়টি খুব জটিল হয়ে যাবে”, বললেন তিনি, “আর তখনই ভেবে নিলাম, স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য পদার্থবিদ্যা নিয়ে বাংলায় কিছু লেখালিখি করব। কাজ শুরুও করলাম। এমন সময় আমার ছেলের মারফৎ খবর পেলাম, এখানে এঁরা পদার্থবিদ্যার শিক্ষক খুঁজছেন। ই-মেলে যোগাযোগ হল। এলাম। কথা হল। এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম।” সঙ্গে হয়তো একটু বাড়তি পাওনা তাঁর নাতনির সান্নিধ্য। এখানকার ছাত্রী সে।
আপাতত মার্চ মাস পর্যন্ত পড়ানোর চুক্তি। তবে অর্ধেন্দু জানেন, সেই মেয়াদ যে বাড়বে না, এখনই এমন কথা বলার সময় আসেনি। এখানকার এডুকেশন সেন্টারের সচিব অধ্যাপক পদ্মনাভন কৃষ্ণ তো বলেই দিলেন, “আমরা অর্ধেন্দু সেনকে ছাড়তে চাই না। তিনি সঙ্গে থাকলে আমরা নানা ভাবে ওঁকে কাজে লাগাতে পারব।” রেজিস্ট্রার পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন, অর্ধেন্দুবাবুর মতো লোক আছেন ও থাকবেন, সেটাই বাঞ্ছনীয়।
আর অর্ধেন্দুবাবু নিজে কী ভাবছেন? শিক্ষকতায় থেকে যাবেন? তিনি অকপট, “মার্চে ছাড়া যাবে বলে তো মনে হয় না। বোধহয় থেকেই যেতে হবে। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়!” সরকারি চাকরিতে অবসরের পরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কয়েকটি নিগমে পরিচালন বোর্ডে আছেন অর্ধেন্দুবাবু। সেই সুবাদে মাঝেমধ্যেই দিল্লি-কলকাতা-শিলং যেতে হয়। তিনি জানান, কৃষ্ণমূর্তি ফাউন্ডেশন তাঁকে এ ব্যাপারে পূর্ণ ছাড়পত্র দিয়েছে।
কৃষ্ণমূর্তি ফাউন্ডেশনের আবহ অনেকটাই শান্তিনিকেতনের মতো। তবে নিয়মের শিকল খুব মজবুত। সকালের চা থেকে রাতের খাওয়া সব সময়ে বাঁধা। নিজের কোয়ার্টার্সে রান্নার ব্যবস্থা রাখেননি বলে সেই নিয়মই মেনে চলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব।
পরিবার গুড়গাঁওতে। তাই দিনের কাজ সেরে ঘরে ফিরে অর্ধেন্দুবাবুর সময় এখন বেশিটাই কাটে পদার্থবিদ্যার বইটি লেখার কাজে। প্রাক্তন আইএএস অর্ধেন্দু সেন কি তবে এভাবেই ‘শিক্ষক’ হয়ে ওঠার স্বীকৃতি পেতে চাইছেন? শুনে হাসেন এবং বলেন, “সরকারি চাকরি করতে গিয়ে ‘স্যার’ তো অনেক শুনেছি। এ বার অন্য রকম ‘স্যার’ হলেই বা ক্ষতি কী!” |
|
|
|
|
|