ভিড়ের চাপে টেবিলটার ভেঙে পড়ার উপক্রম। চারদিকে গিজগিজ করছে কালো মাথার সারি। পরিস্থিতি সামলাতে নাকানিচোবানি খাচ্ছেন গ্যাটউইক বিমানবন্দরের কর্মীরা। খারাপ আবহাওয়ায় গত কয়েক দিনে শুধু এখানেই বাতিল হয়েছে একশোরও বেশি উড়ান। কখন পরিষেবা চালু হবে, জানা নেই কারও। চালু হলেও বিমানে জায়গা মেলা ভার। কপালে হাত যাত্রীদের। বলছেন, “এ বারে আর বড়দিনে বাড়ি ফেরা হল না!”
ব্রিটেনে কমবেশি সর্বত্রই এই একই চেহারা। ভবিষ্যদ্বাণীও তেমনটাই ছিল। উৎসবের কাউন্ট ডাউন শুরুর বহু আগে থেকেই আভাসও দিয়ে চলেছিল টানা বৃষ্টি, ঝড়ঝঞ্ঝা। কিন্তু ব্রিটেনের সীমা ছাড়িয়ে প্রকৃতির কোপ থেকে বাঁচল না প্রায় অর্ধেক ইউরোপ। নিস্তার নেই মার্কিন মুলুকেরও। তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত আমেরিকা-কানাডা। এখনও ২৪ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। |
নাস্তিকেরাও আসুন, শান্তির বিশ্ব গড়ে তুলি। বড়দিনে ভ্যাটিকানে পোপের আহ্বান। ছবি: এএফপি। |
বড়দিনের মরসুমে ঘরবন্দি অর্ধেক বিশ্ব। ঘরে থেকেও অবশ্য নিস্তার নেই ঝড়ের প্রকোপ থেকে। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। উত্তর-পূর্ব আমেরিকা ও পূর্ব কানাডায় অন্ধকারে ডুবে বহু অঞ্চল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিনরাত এক করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারি কর্মীরা। আবহ দফতরের মুখপাত্র জানিয়ে দিয়েছেন, এখনই রেহাই মিলছে না। আগামী কয়েক দিনে আরও তুষারপাত হবে।
ব্রিটেনের অবস্থাও তথৈবচ। কাল থেকেই বিদ্যুৎহীন ৭০ হাজার বাড়ি। ক্রিসমাস ইভ-টা অন্ধকারেই কাটালেন বাসিন্দারা। প্রশাসনের আশ্বাস, বড়দিনের মধ্যেই কেন্ট-সারে-সাসেক্সে আলো ফিরবে। সোমবার ঝড়ের পর বিদ্যুৎ বিপর্যয়েই গ্যাটউইকের ওই অবস্থা। দু’টো সাবস্টেশন বসে গিয়েছে। বাতিল হয়ে যাওয়া উড়ানের যাত্রীদের অন্য বিমানে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে চেষ্টা বৃথাই। বহু ক্ষেত্রেই যাত্রীদের শুনতে হচ্ছে, “বাড়ি যান। পরিষেবা চালুর কোনও সম্ভাবনাই নেই।” কিন্তু যাত্রীদের অধিকাংশ তো বাড়ি ফেরার পথেই আটকে পড়েছেন। ফিরবেন কোথায়? তা-ই বিমানবন্দরই অস্থায়ী আস্তানা। সেখানেও পা ফেলার জায়গা নেই। মালপত্রের উপরই গা এলিয়েছেন অনেকে। ঠান্ডার মধ্যে অনেকে শুয়ে পড়েছেন মেঝেতে। |
কোথায় উৎসব? বেলজিয়ামের কুভ্যাঁ শহর ভাসছে ও’ নোয়ার নদীর জলে। ছবি:রয়টার্স। |
অন্য বিমানে ভাগ্যক্রমে যাঁদের জায়গা জুটছে, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে “মালপত্র নেবেন না। যেটুকু হাতে করে নেওয়া যায়, সেটুকু জিনিসই নিন।” সুতরাং বাড়ি পৌঁছতে পারলেও, প্রিয়জনের জন্য কেনা উপহার পড়ে থাকছে বিমানবন্দরেই।
একচিলতে জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত ৩৭ বছরের গ্রেজিয়েলা ভেলা। কোথায় বসবেন, কোথায়ই বা জিনিসপত্র রাখবেন। তার উপর আবার ছ’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বললেন, “মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনও খবর দিতে পারছে না। কোনও বিকল্প ব্যবস্থাও দেখছি না।” এক যাত্রী টুইট করেছেন, “গ্যাটউইক বিমানবন্দরের ভয়ানক অবস্থা। বিদ্যুৎ নেই। কম্পিউটারগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। বিমান উড়লেও ব্যাগপত্তর নেওয়ার উপায় নেই। আর মেঝেতে থিকথিক করছে লোক।” |
বাতিল বহু উড়ান। যাত্রীদের জায়গা দিতে বিমানে নেওয়া চলবে না বেশি জিনিস।
বড়দিনের অনেক উপহারই তাই আটকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে। ছবি: এপি। |
প্রশাসন সূত্রে খবর, গ্যাটউইকের এ অবস্থার জন্য দায়ী একের পর এক ট্রেন বাতিল। রেল লাইনে গাছ পড়ে। মধ্য লন্ডনের ট্রেন পরিষেবা তাই বেহাল। আর তাতেই ভিড়ের রাশ গিয়ে পড়েছে বিমানবন্দরগুলোয়। পশ্চিম সাসেক্স-মুখী ইজি-জেটের ১০টি বিমান মাঝপথে লিভারপুলের জন লেনন বিমানবন্দরে নামিয়ে দেয় যাত্রীদের। বলা হয়, নিজের মতো ব্যবস্থা করে নিন। এরই মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রকের তরফে বন্যার জন্য বিপদসঙ্কেত দেওয়া হয়েছে ২৭৬টি অঞ্চলে। ডেভনে এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর মিলেছে। পোষা কুকুরটাকে বাঁচাতে নদীতে ঝাপ দিয়েছিলেন তিনি। ভেসে যান তার সঙ্গেই।
বড়দিনের মরসুমে জলমগ্ন ফ্রান্স, বেলজিয়াম। ফ্রান্সেও প্রায় দু’লক্ষ বাড়ি বিদ্যুৎহীন। তাই বাধ্য হয়েই বড়দিনের আগের রাতে ক্যান্ডল-লাইট ডিনার সারলেন বাসিন্দারা। জলপথ, কী সড়কপথ বা বিমান পরিষেবা ব্যাহত সবই। বেলজিয়ামে কুভ্যাঁর অবস্থা দেখেশুনে খানিকটা ভেনিসের মতোই লাগছে। নদীর চেহারা নিয়েছে রাস্তা।
এ বারের মতো মাটি হল বড়দিন। নতুন বছরে প্রকৃতির মুখ ভার কাটবে কি, জানে শুধু সময়। |