বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকে মেঘ তৈরির পালা শুরু হয়েছিল সেই জুনে। তার পরে ছ’-ছ’টা মাস কেটে গিয়েছে। কিন্তু আকাশ থেকে মেঘ প্রায় সরেইনি। ওই বাদলমেঘের জন্যই শরৎকালটা যে কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছে, বোঝা যায়নি। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ কবে এল এবং কবে গেল, বুঝতেই পারেনি বাঙালি। পৌষেও মেঘের ঘাটতি নেই। যেন বড়দিনের শীতটাকে মাটি করার অভিসন্ধি নিয়েই সকাল থেকে কুয়াশার চাদর বিছিয়ে রেখেছে সে! অনেক বেলা পর্যন্ত দেখতে দিচ্ছে না সূর্যের মুখ।
এই অবস্থায় বড় প্রশ্ন, এ বারের বড়দিন কি তা হলে শীত-হীনই হচ্ছে?
আজ, বুধবার বড়দিনে শীতের দাক্ষিণ্যের তেমন আশা দিতে পারেনি আলিপুর আবহাওয়া দফতর। তাদের হিসেব অনুযায়ী আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় মঙ্গলবার কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের চেয়ে চার ডিগ্রি বেশি। আরও কিছুটা কমে সেটা আজ বড়জোর ১৭ ডিগ্রিতে নামতে পারে। অর্থাৎ সে-ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি বেশিই হবে।
মরসুমের শুরু থেকে আশা দিয়েও কার্যক্ষেত্রে শীত এ বার এত কৃপণতা করে চলেছে কেন?
আবহবিদেরা বলছেন, এ বার গোটা পূর্ব ভারত থেকেই মুখ ঘুরিয়ে আছে শীত। এবং এর জন্য দায়ী উত্তরপ্রদেশের উপরে তৈরি ঘূর্ণাবর্ত। জুন থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একের পর এক নিম্নচাপ অক্ষরেখা, নিম্নচাপ এবং চার-চারটি ঘূর্ণিঝড় আকাশের বুকে কালো মেঘের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় তৈরির মতো পরিস্থিতি নেই বটে, কিন্তু নতুন বিপদ তৈরি করেছে স্থলভূমিতে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্ত।
আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে কাশ্মীরে ঢুকছে একের পর এক পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। সেই ঝঞ্ঝা ক্রমশ নেমে আসছে নীচের দিকে। তার সাহায্যেই উত্তরপ্রদেশের উপরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্তটি জাঁকিয়ে বসেছে বলে আবহবিদদের অনেকের ধারণা। ওই ঘূর্ণাবর্তই বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢোকাচ্ছে পরিমণ্ডলে। তৈরি হচ্ছে মেঘের আস্তরণ।
দিল্লির মৌসম ভবনের পূর্বাভাস, কাশ্মীরে গত দিন দুয়েকের মধ্যে নতুন কোনও পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ঢোকেনি। তাই এ বার উত্তরপ্রদেশের ঘূর্ণাবর্তটি ধীরে ধীরে শক্তি হারাবে বলেই মনে করছেন আবহবিদদের একাংশ। ইতিমধ্যেই উত্তর ভারত থেকে উত্তুরে হাওয়া গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের পরিমণ্ডলে
ঢুকতে শুরু করেছে। কিন্তু আকাশ পুরোপুরি মেঘমুক্ত না-হলে সারা দিন সূর্যের মুখ দেখা যাবে না। আর দিনের বেলা তাপমাত্রা না-বাড়লে কমবে না রাতের তাপমাত্রাও।
মেঘের হাতে শীতের এ ভাবে নাস্তানাবুদ হওয়াটা কি আবহাওয়া পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে?
এটাকে আবহাওয়ার কোনও পরিবর্তন বলে মানতে রাজি নন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ। তিনি জানান, গত ১৩ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সময়ে কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের উপরে ছিল মাত্র পাঁচ বার। চার বার তা ছিল স্বাভাবিকই। চলতি বছরকে বাদ দিলে আগের চার বারই ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল এই সময়ের স্বাভাবিকের থেকে কম। “সুতরাং আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়ে গেল, এখনই এমনটা মনে করা ঠিক হবে না,” মন্তব্য গোকুলবাবুর।
শীতের গড়িমসিতে খুব একটা অবাক নন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহবিজ্ঞান দফতরের অধ্যাপক সুগত হাজরাও। তাঁর মন্তব্য, “এমনটাই তো হওয়ার ছিল।” কেন?
সুগতবাবু জানান, কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা খুব একটা নামছে না। এমনটা হঠাৎ করে হয়নি। এটা একটা ধারাবাহিক ব্যাপার। আর এটা ঘটছে পৃথিবীর সর্বত্রই। উত্তর গোলার্ধে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। লন্ডনে নিম্নচাপের জেরে ঝড়বৃষ্টিতে বাধা পাচ্ছে শীত।
সুগতবাবু বলেন, “এত দিন ধরে আমরা যে-কাজটা করছিলাম, তা ছিল আবহাওয়ার এমন গতিপ্রকৃতি নিয়েই। সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ার জন্য বঙ্গোপসাগরে ঘনঘন নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। তার জেরে বঙ্গোপসাগর এবং আরবসাগর এলাকায় ঘনঘন ঝড় যে হবে, ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর পঞ্চম রিপোর্টে তা বলে দেওয়া হয়েছে।” সুগতবাবুর আশঙ্কা, আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শীতের ফসল।
শীত কি মোটেই সদয় হবে না?
হাওয়া অফিসের ধারণা, বড়দিনে না-হোক, ইংরেজি নতুন বছর আসবে শীতের হাত ধরেই। আবহবিদেরা বলছেন, কাল, বৃহস্পতিবার থেকে তাপমাত্রা দ্রুত নামার ইঙ্গিত মিলেছে। সপ্তাহের শেষে মহানগরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে কমে ১৩ ডিগ্রিতে পৌঁছে যেতে পারে।
|
যেখানে পারদ
২৪ ডিসেম্বর |
সাল |
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা* |
২০০১ |
১৩.৯ |
২০০২ |
১৫.৪ |
২০০৩ |
১৩.৮ |
২০০৪ |
১৮.৩ |
২০০৫ |
১৬.৬ |
২০০৬ |
১৬.৩ |
২০০৭ |
১৩.৯ |
২০০৮ |
১৪.০ |
২০০৯ |
১২.৫ |
২০১০ |
১২.৯ |
২০১১ |
১১.৪ |
২০১২ |
১৩.৩ |
২০১৩ |
১৭.৮ |
এ সময়ের স্বাভাবিক |
১৪.০ |
(*ডিগ্রি সেলসিয়াসে) |
|