পাঁচ গোলের জুজুতে গরহাজির মোহনবাগান, ভাস্করও
সোনার স্মৃতি আর নতুন প্রতিজ্ঞায়
উজ্জ্বল ইস্টবেঙ্গলের মায়াবী রাত
প্রাক্-শতবর্ষ উৎসবের সূচনাতেই এক কিকে একশো! বলে বলে গোল।
কী নেই! লেজার বিমের ঝলকানি, যুবভারতী জুড়ে সাইকেডেলিক আলোর দৌরাত্ম্য, ক্রেনে চেপে নায়িকার আগমন, নায়কও যে এলেন ঘোড়ায় চেপে! সঙ্গে ডেসিবেল ছাপানো শব্দব্রহ্ম। এর সঙ্গে জুড়তে হবে প্রতিজ্ঞা, স্মৃতির সরণি বেয়ে মধুর ফ্ল্যাশব্যাক, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ককটেল। টুকরো টুকরো এ রকম নানা কোলাজে এটাই লাল-হলুদের শতবর্ষ উৎসবের ছ’ধাপ আগের আনন্দ-সন্ধ্যা।
কী রকম? মঞ্চে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর শ্রুতিমধুর কণ্ঠে ‘দুরন্ত আশা’ আবৃত্তি তখন মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে যুবভারতীকে। পঁচাত্তরের টানা ছ’বার লিগ জয়ী এবং ঐতিহাসিক পাঁচ গোলের দলকে তার কিছু আগেই সংবর্ধিত করেছেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ঠিক সেই সময়ই স্ত্রী অ্যাডাকে নিয়ে সপরিবারে ঢুকলেন লাল-হলুদের এখনকার গোলমেশিন এডে চিডি। ঠোঁটে উত্তর বোধহয় তৈরি করেই বেরিয়েছিলেন। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বললেন, “এই অনুষ্ঠান তো অনুপ্রেরণার। আটত্রিশ বছর আগে এই ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তনরাই তো ছ’বার লিগ জিতে রেকর্ড করেছিলেন। যা আজও ভাঙেনি। আমরা তিন বার লিগ জিতেছি। চেষ্টা করতে হবে এই রেকর্ড স্পর্শ করার।” অদূরে দাঁড়ানো লাল-হলুদ অধিনায়ক মেহতাব আবার বললেন, “সচিন তেন্ডুলকর, মেসি এবং পেলের রেকর্ড ছাড়া বাকি সব রেকর্ডই ভাঙা সম্ভব।”

মঞ্চে পঁচাত্তরের সেই ঐতিহাসিক দলের সংবর্ধনা সৌরভের হাত দিয়ে।
তার আগেই মঞ্চে সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্তদের সামনে মধুর স্মৃতিচারণ সেরে ফেলেছেন সৌরভ। বলেছেন, “ফুটবলাররা ১৯৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গলকে যে সম্মান উপহার দিয়েছিল, ক্লাব আজ তা যোগ্য মর্যাদা দিয়ে ফেরাল।” এখানেই থামলেন না ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’। বললেন, “পঁচাত্তর সালে আমার বয়স ছিল মাত্র তিন। তখন কলকাতা ফুটবলের আবেগ বোঝার বয়স ছিল না। যবে থেকে ফুটবল বুঝতে শিখলাম, সে দিন থেকেই এই দলের শ্যাম থাপা, সুরজিৎ সেনগুপ্তরা আমার হিরো।” স্টেডিয়াম জুড়ে তখন করতালির ঢেউ। সৌরভকেও সোনার বুট এবং উত্তরীয় পরিয়ে এ দিন মঞ্চে সংবর্ধনা দেওয়া হয় ইস্টবেঙ্গলের তরফে।
আর যাঁদের সৌজন্যে সত্তরের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয়ের পর লাল-হলুদ জনতা প্রথম বার গ্যালারিতে মশাল জ্বালিয়েছিলেন, তাঁরা? সে দিনের অধিনায়ক শান্ত মিত্র এবং গোলদাতা পরিমল দে যুবভারতী পৌঁছে গিয়েছিলেন অনুষ্ঠান শুরুর কিছু আগেই। কিন্তু তার পর কোথায় গেলেন তাঁরা? খোঁজ পাওয়া গেল পাঁচটা পঞ্চান্ন নাগাদ। মঞ্চ ফুঁড়ে এলিভেটরে তাঁরা উঠে এলেন। হাতে লাল-হলুদ জনতার সেই আদি ও অকৃত্রিম মশাল। দু’পা এগোতেই দুই প্রাক্তনকে সঙ্গ দিলেন বর্তমান দলের অধিনায়ক এবং তাঁর সহকারী মেহতাব এবং হরমনজ্যোৎ সিংহ খাবরা। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে স্থানান্তরিত হল লাল-হলুদের পূতাগ্নি।
সংবর্ধিত হয়ে আবেগাপ্লুত দুই প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গলি। বললেন, “এই সম্মান প্রাক্তন এবং বর্তমানকে আরও কাছে এনে দিল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব যে কখনও তার পুরনো ফুটবলারদের ভুলে যায় না, তা আজ আরও এক বার প্রমাণ হয়ে গেল।”

এই প্রজন্মের মেহতাব-খাবরাদের হাতে
মশাল তুলে দিলেন শান্ত মিত্র-পরিমল দে।
তবে সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তটি এল পঁচাত্তরের দল যখন মঞ্চে এল। সুভাষ, শ্যাম, শুভঙ্কর, সুরজিৎ, রঞ্জিৎ আর তাঁদের কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে গ্যালারি পলকে উত্তাল। মঞ্চে সৌরভও তার বাইরে বেরোতে পারলেন না। জড়িয়ে ধরলেন সুভাষ ভৌমিককে। লাল-হলুদের আসিয়ান জয়ী কোচ বাড়ি ফেরার আগে বলেও গেলেন, “ইস্টবেঙ্গলে গৌরবের মুহূর্ত বলে শেষ করা যাবে না। তবে আজকের রাতে আমার কাছে পঁচাত্তরের দলের গৌরবই সবার আগে।” লাল-হলুদের এই ইতিহাস গড়া দলও পেল সোনার বুট, স্মারক ও উত্তরীয়।
অসুস্থতা এবং পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে আশ্চর্যজনক ভাবে অনুষ্ঠানে ছিলেন না এই দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গৌতম সরকার এবং সুধীর কর্মকার। সুরজিৎ সেনগুপ্ত এই সংবর্ধনা উৎসর্গ করলেন ওই দলের প্রয়াত অধিনায়ক অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
কিন্তু ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় গেলেন কোথায়? কর্তারা অনুষ্ঠানের যে ফ্লো চার্ট তৈরি করেছিলেন, তাতে সৌরভকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা ছিল ইস্টবেঙ্গলের দুই ঘরের ছেলে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং ভাস্করের। পঁচাত্তরের দলকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা শুনেই ভাস্কর আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, “কর্তারা বুদ্ধিমান হলে আমাকে ডাকবেন না।” কিন্তু কর্তারা প্রথমে পাঁচ গোলের দলকে সংবর্ধনা দেবেন বললেও পরে মত বদলান। সত্তর থেকে পঁচাত্তর পরপর ছ’বছর লিগ জয়ের ব্যাপারটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ভাস্কর তত দিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর ‘বেটার হাফ’ মলি গঙ্গোপাধ্যায় আবার লাল-হলুদের কর্মসমিতির সদস্য। ছিলেন দর্শকাসনে। ফোনে ধরা হলে ‘ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে’ বললেন, “আজ গেলাম না। একটা কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম। পঁচাত্তরের ওই ম্যাচের পর তো শেষই হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর যা সাফল্য, সব ইস্টবেঙ্গলে খেলেই। সুতরাং ইস্টবেঙ্গলের সব কিছুর সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব।” তা হলে ক্লাবের এই আনন্দ-উৎসবের দিনে আপনি অনুপস্থিত কেন? ভাস্কর বললেন, “পঁচাত্তরের দলের কথা উঠলে সেই আমার কথাই তো ঘুরে ফিরে আসে। খারাপ লাগে। তাই যাইনি।”
কিন্তু মনোরঞ্জন? তিনি তো আর পঁচাত্তরে ইস্ট-মোহন কোনও দলেই ছিলেন না! অনুষ্ঠান করার সময় প্রীতমও তাঁর ‘মনাদা’-র কথা বলেন। সেই মনাও না আসায় কর্তারা অবাক।
লাল-হলুদের ‘এক কিকে একশো’। ঘোড়ায় চড়ে এলেন অক্ষয়। মঞ্চে ঝড় তুললেন সোনাক্ষীর সঙ্গে।
ভাস্করের পঁচাত্তরের দল মোহনবাগানও এই সংবর্ধনায় পাঁচ গোলের ভূত দেখেছিল। তাই এ দিন সবুজ-মেরুনের কোনও প্রতিনিধি ছিলেন না অনুষ্ঠানে। ময়দানে রটে যায়, মোহনবাগান অনুষ্ঠান বয়কট করেছে। মোহন-কর্তারা এই অভিযোগ মানতে নারাজ। ক্লাবের সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু বললেন, “আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছি। বাইরে ছিলাম বলে যাওয়া হল না। বারাসতে আমাদের একই সময়ে ম্যাচ থাকায় অন্য কর্তারা সেখানে ব্যস্ত ছিলেন। না হলে কেউ না কেউ ঠিক যেত।”
বিতর্কের ঘনঘটা সরালেন বিনোদন জগতের ‘হুজ হু’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, “ইস্টবেঙ্গলে পঞ্চপাণ্ডবকে দেখে বড় হয়েছি। লাল-হলুদ জার্সির প্রতি একটা চাপা আকর্ষণ বরাবরই ছিল। আজ তা পূর্ণ হল গলায় লাল-হলুদ স্কার্ফ জড়িয়ে।”
যা আরও উসকে দিলেন প্রীতম মঞ্চে এসে। ব্যাকড্রপে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের ক্লিপিং। গোল করছে ইস্টবেঙ্গল। আনন্দে মুখর সমর্থকরা। ইস্টবেঙ্গলের ১০ নম্বর জার্সি পরে মঞ্চে ওঠা প্রীতমের গলা থেকে বেরিয়ে এল, “লালে আর হলুদেতে আমাদের ছিল আবেগ। ছিল নস্ট্যালজিয়া। ছিল পাঁচ গোলের জুজুও। সে সব ছাপিয়ে শনিবারের যুবভারতী পেল এক আনন্দঘন সন্ধ্যা। যা মনে করাল ‘হোপ ৮৬’র সোনালি স্মৃতি।

পাঁচ গোলের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের প্রধান নায়ক সুভাষ ভৌমিককে
পুষ্পস্তবক দিয়ে সম্মান জানাচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.