প্রাক্-প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী মাতিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। আর ইস্টবেঙ্গলে শতবর্ষ উদযাপনের ঢাকে কাঠি পড়তেই সেই লতার শহর থেকেই উড়ে এলেন বলিউডের ‘খিলাড়ি’ অক্ষয়কুমার। এবং তাঁবুতে পা দিয়েই ‘এক কিকে একশো’র ঢঙে বললেন, “ভারতে ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে জনপ্রিয় আর কিছুই হতে পারে না।”
শুক্রবারের পড়ন্ত বিকেলে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর লনে সোনাক্ষীকে পাশে বসিয়ে অক্ষয় যখন এ কথা বলছেন তখন ক্লাব জুড়ে করতালির বন্যা। সঙ্গে জয়ধ্বনি বলিউডের নতুন ‘বস’ অক্ষয়ের জন্য। নীল-সাদা ট্র্যাকস্যুটের আপার আর ধূসর ট্রাউজার্স। তা-ও আবার এক পা গুটনো। তৈরি হয়ে এসেছিলেন চিডি-মেহতাবদের সঙ্গে ফুটবল খেলবেন বলে। মাঠে ঢুকেই বল মারলেন দীপঙ্কর রায়ের দিকে। অক্ষয়কে দেখে সৌজন্য বিনিময় করতে চলে এল কোচ আর্মান্দো-সহ গোটা দল।
কিন্তু সময় বয়ে যাচ্ছে যে! সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য তৈরি ক্লাব কর্তারা। সহ-অধিনায়ক হরমনজ্যোৎ সিংহ খাবরা অনুরোধও করলেন দেশোয়ালিকে খেলার জন্য। উত্তর এল, “তোমাদের দেখে লাল-হলুদ জার্সি পরে খেলার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু হাতে সময় নেই। খেলাটা তোলা থাকল।” |
লাল-হলুদ জার্সি। খিলাড়ি এবং সোনাক্ষী। শুক্রবার। |
সময় যদি এ দিন মাঠে বল পায়ে অক্ষয়ের না নামার একটা কারণ হয়, দ্বিতীয় কারণটা অবশ্যই জার্সি। অক্ষয়ের পরিকল্পনা ছিল বিমানবন্দর থেকেই লাল-হলুদ জার্সি পরে ঢুকবেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে। কিন্তু তাঁর জন্য যে জার্সি পাঠানো হয় তা অক্ষয়ের ছোট হয়েছে। খবর শুনেই তড়িঘড়ি আরও এক সেট বড় জার্সি বানানোর অর্ডার গিয়েছে ক্লাবের তরফে। কিন্তু সেটা অক্ষয়ের সাঁইত্রিশ মিনিটের ক্লাব পরিদর্শনের ফাঁকে জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। ক্লাবের অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার যদিও বললেন, “ওর মাপের জার্সি অনুষ্ঠানের আগে তৈরি হয়ে যাবে।”
ঘড়িতে তিনটে পঞ্চান্ন। সভাপতি, সচিব-সহ শীর্ষ কর্তারা ফুলের তোড়া নিয়ে অক্ষয়ের অপেক্ষায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। ঝড়ের বেগে তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়াল দুধসাদা ডব্লিউবি ০৪ডি ১৮৮৭ নম্বরের বিএমডব্লিউ।
অনুরাগীদের উপচে পড়া ভিড় দেখে গাড়ি ক্লাবের ভিতরেই ঢুকিয়ে নিলেন কর্তারা। গাড়ি থেকে নেমেই সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে দুই তারকা ঢুকে পড়লেন ক্লাব-তাঁবুতে। ক্লাবের প্রাণপুরুষ জ্যোতিষ গুহ, পল্টু দাসদের শ্রদ্ধা জানিয়েই সোজা মেহতাবদের ড্রেসিংরুমে। সেখানে ঢুকেই সোনাক্ষীকে টিপ্পনি, “কী রে, তুই নাকি ফুটবল খেলতি। এ রকম ড্রেসিংরুম আগে দেখেছিস?” শত্রুঘ্ন-কন্যা তখন মুখ টিপে হাসছেন। এ বার অক্ষয় ফিরলেন কর্তাদের দিকে। বললেন, “মুম্বইতে নেই, মনেই হচ্ছে না। আশির দশকে তিন বছর থেকে গিয়েছি এই শহরে। এই ক্লাব তো ভারতসেরা। চুরানব্বইয়ে শেষ বার মিঠুনদা-র সঙ্গে যুবভারতীতে খেলেছিলাম।” শনিবারের যুবভারতীতে অক্ষয়-সোনাক্ষী-প্রীতম ম্যাজিক দেখতে হাজির থাকবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও। পঁচাত্তরের ইস্টবেঙ্গল সংবর্ধিত হবে প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের হাত দিয়েই।
|
বিকেল চারটে পাঁচ। অক্ষয় ঢুকে পড়লেন মাঠে। ফুটবলারদের সঙ্গে পরিচিতি পর্ব। সেখানে নায়কের প্রথম প্রশ্ন, “এখানে সবচেয়ে কমবয়সি কে?” কর্তারা দেখিয়ে দিলেন লেনকে। লেনের বয়স মোটে কুড়ি শুনে অক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া, “দম লাগাকে খেলো। আমি স্কুলে গোলকিপার ছিলাম জানো?” পাশ থেকে এ বার ফুট কাটলেন সোনাক্ষী, “আরে সেটা তো আমি ছিলাম।” রোদচশমা ঢাকা নায়কের মুখে তখন হাসির ঝিলিক। এক কর্তা বললেন, “এখানে পাঁচ-ছ’জন পঞ্জাবি ফুটবলার রয়েছে। দেখিয়ে দেওয়া হল গুরবিন্দর, গুরপ্রীতদের। এ বার গুরুমুখীতে কথা শুরু অক্ষয়ের। ততক্ষণে সামনে চলে এসেছেন চিডি। তাঁকে দেখে রসিকতা, “তুমিও পঞ্জাবি?”
চারটে পনেরো। অক্ষয় ঢুকলেন লাল-হলুদের জিমে। মেহতাবদের অত্যাধুনিক জিম দেখে নিজেই শুরু করে দিলেন ওয়ার্ক আউট। চারটে কুড়ি। বসে পড়লেন সাংবাদিক সম্মেলনে। লাল-হলুদের তরফে অক্ষয়কে বরণ করে নেওয়া হল ধুতি, পাঞ্জাবি, স্মারক এবং চকোলেট দিয়ে। শ্যাম থাপা তুলে দিলেন লাল-হলুদের শতবার্ষিকী জার্সি। যাতে স্বাক্ষর করে দিলেন অক্ষয়রা। সোনাক্ষীর জন্য এল শাড়ি। কিন্তু অক্ষয়ের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে থাকল, ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ। আপ্লুত অক্ষয় বলেই ফেললেন, “আমার অভিনয়-জীবনের সূত্রপাত প্রমোদ চক্রবর্তীর হাত ধরে। উনি এই ক্লাব সম্পর্কে আমাকে অনেক কথা বলতেন। আর কলকাতা তো আমার কাছে খেলার শহর।”
|
লাল-হলুদ জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ছেন
অক্ষয়-সোনাক্ষী। শুক্রবার ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে। |
ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ও ব্রাজিলের সমর্থক অক্ষয় মুম্বইয়ে মার্শাল আর্টের টুর্নামেন্ট আয়োজন করেন প্রতি বছর। সেই প্রসঙ্গ টেনে বললেন, “দেশে ইদানীং শৃঙ্খলার অভাব। তাই প্রত্যেক স্কুলে মার্শাল আর্ট চালু করা উচিত। আমরা কেন ‘সেলফ ডিফেন্স’কে গুরুত্ব দেব না?” বিকেল চারটে বত্রিশ। তাঁবু ছেড়ে যুবভারতীতে রিহার্সালের জন্য ছুটল অক্ষয়ের বিএমডব্লিউ। যাওয়ার পথে অনুরাগীদের বলে গেলেন, “কাল আসুন। সবাই মিলে আনন্দ করি।” যে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মোহনবাগান, মহমেডান-সহ ভারতের সব আই লিগ ক্লাবই। মহমেডান কর্তারা অনুষ্ঠানে যাবেন বলে ঠিক করলেও, শনিবার আই লিগে পুণে এফসি ম্যাচে ব্যস্ত থাকায় বাগান-প্রতিনিধির থাকার সম্ভাবনা নিয়ে যদি-কিন্তু রয়েছেই।
’৮৮-তে লতার টানে ভরে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল মাঠ। শনিবারের যুবভারতী অক্ষয়ের ডাকে কানায় কানায় ভরবে? সে বারের ফুটবল সচিব, বর্তমানে লাল-হলুদের বিরোধী গোষ্ঠীর কর্তা সুপ্রকাশ গড়গড়ি প্রশ্ন শুনে বলছেন, “ক্লাব আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। যেতে পারি। তবে লতার বেলা আঠাশ লক্ষ টাকা ক্লাবের লাভ হয়েছিল। অক্ষয় ক্লাবের তহবিল বাড়াতে পারলে ভালই লাগবে।” |