বুকে চাপড় মেরে দিয়েগো মারাদোনার ঢঙে করিম বেঞ্চারিফা মনে হল বলতে চাইছিলেন, ‘আমি পারি, আমিই পারি’।
কখনও বাগান কোচ টেকনিক্যাল এরিয়ায় দাঁড়িয়ে নাচছেন, গ্যালারিকে দু’হাত তুলে জয়ধ্বনি দিতে বলছেন।
কিছুক্ষণ পর আবার মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে বলছেন, “ইয়েস, ইয়েস। উই ক্যান।’’
গোলের পর ওকোলি ওডাফাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে মাথা নাড়ছিলেন করিম। রাম মালিককে কোলে তুলে এর পর। পরক্ষণেই প্রীতম আর শৌভিককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
উল্টো দিকের রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকা পুণে এফ সি-র ডাচ কোচ মাইক স্নোয়ি আর স্থির থাকতে পারলেন না। “আরে মশাই যা করছেন, মনে হচ্ছে পাগলা গারদটাই আপনার সঠিক জায়গা। রিজার্ভ বেঞ্চ নয়।”
করিমও পাল্টা দিলেন। “অনেক কথা বলেছেন আমার ফুটবলারদের সম্পর্কে। যা জবাব দেওয়ার দিয়ে দিয়েছি।” শুরু হয়ে গেল নজিরবিহীন তর্কাতর্কি। রিজার্ভ বেঞ্চ বনাম রিজার্ভ বেঞ্চের লড়াই।
খাদের কিনারা থেকে বেঁচে ফেরা কোনও কোচের উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ কি এ রকমই হয়?
ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও মাঝেমধ্যে নতুন প্রাণের খোঁজ পাওয়া যায়।
হাই প্রোফাইল টিম পুণের বিরুদ্ধে নাটকীয় এবং চমকপ্রদ জয়ের ধাক্কায় মোহনবাগানে সার্বিক ভাবে কতটা প্রাণের সঞ্চার হবে তা সময় বলবে।
কিন্তু বারাসতে শনিবার এক সঙ্গে পুনর্জীবন হল অনেক কিছুরই।
চাকরি বাঁচল করিম বেঞ্চারিফার! আপাতত ফেড কাপ পর্যন্ত তিনি নিশ্চিন্ত।
কর্তাদের গিলোটিনের নীচ থেকে বেঁচে ফিরলেন ওকোলি ওডাফা। জোড়া গোল করে এই মরসুমের জন্য টিঁকে গেলেন তিনি।
অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বেড়ানো সবুজ-মেরুন সমর্থকদেরও যেন ‘প্রাণ’ দিল পুণে-জয়। না হলে যে-ম্যাচটা জিতে বাগান লিগ টেবিলে পাঁচের মধ্যেও ঢুকতে পারল না, সেই ম্যাচ জেতার পর কেন গ্যালারি থেকে দাবি উঠবে, “করিমদা একটা ভিকট্রি ল্যাপ হয়ে যাক।” টিম বাস ঘিরে এমন উচ্ছ্বাসও বা কেন দেখাবে জনতা?
লিগ টেবিলের ‘লাস্ট বয়’ রাঙ্গদাজিদের কাছে বিশ্রী হার, ভাঙাচোরা ডেম্পোর কাছেও পর্যুদস্ত। সেই মোহনবাগান কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় হঠাৎ এমন সোনা ফলিয়ে ফেলল? করিম তিনটি শব্দ বলছেন, “টিম বন্ডিং। ডেডিকেশন। হাঙ্গার।” মোহন কোচের দাবি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ম্যাচটা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে ফেলার পর চৌম্বকে সেটা ধরাও পড়ছে। না হলে, যে টিমটার কাছে আ্যওয়ে ম্যাচে দু’গোল হজম করে এসেছিলেন ইচে-কাতসুমিরা, সেই পুণের বিরুদ্ধেই মসৃণ ৩-১ জয়। খেলার ফল হতে পারত ৫-৩ বা ৬-৪। পোস্টে লেগে অন্তত তিনটে বল ফিরল দু’দলের। বাগান ১-০ এগিয়ে থাকা অবস্থায় নিজেদের গোল লাইন থেকে পুণের কেলামের শট ফেরালেন সাবিথ। ওয়ান টু ওয়ান অবস্থায় বিপক্ষের কিপারকে একা পেয়েও ওডাফা গোল করতে পারলেন না। অন্তত দু’টি নিশ্চিত গোল বাঁচালেন বাগান কিপার শিলটন পাল। |
চাকরি বেঁচেছে। যুবভারতীতে উল্লসিত
করিমের কোলে রাম। শনিবার। ছবি:উৎপল সরকার।
|
মরক্কান বনাম ডাচের স্ট্র্যাটেজির লড়াইটা অবশ্য ছিল হাড্ডাহাড্ডি। তীব্র উত্তেজনায় মোড়া। ধাক্কাধাক্কি, বিশ্রী ফাউল, রেফারির দিকে তেড়ে যাওয়া বাদ গেল না কিছুই। ডেনসনকে দিয়ে করিম আটকালেন ডুহু পিয়েরকে। ফলে মাঝমাঠ থেকে বল না পেয়ে পুণের ‘দ্য বুলেট’ মুস্তাফা রিগা ভোঁতা হয়ে গেলেন। ‘জাপানি বোমা’ কাতসুমিকে চরকির মতো মাঝমাঠে ঘোরালেন বাগান কোচ। বিপক্ষের পায়ে বল পড়লেই তাড়া করছিলেন তিনি। পাল্টা দিলেন পুণে কোচও। টিমকে ৪-২-৩-১ থেকে কখনও ৩-৫-২ বা ৩-৪-৩ করে দিয়ে ধাঁধায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন বাগানকে। দ্বিতীয়ার্ধে একটা সময় মনে হচ্ছিল ম্যাচটা পুণের মুঠোয় না চলে যায়। আর তখনই বর্ধমানের রাম মালিকের গোল বোঝালবাংলার গ্রাম এখনও ভাল ফুটবলারের জন্ম দেয়। এ দিন ম্যাচ-সেরা হলেন ওডাফা। দেওয়া উচিত ছিল চোরা গতিতে বিপক্ষকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া ছোটখাটো চেহারার রামকে।
ওডাফা দু’টো গোল করেছেন। গোলগুলো অবশ্য উৎসর্গ করেছেন কোচকে নয়, ক্লাব প্রেসিডেন্ট আর ফুটবল সচিবকে। বলে দিয়েছেন, “মনে হচ্ছে আমি যেন আজ নতুন জীবন পেলাম।” তা সত্ত্বেও গোলমেশিন নিয়ে এখনও দারুণ আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। কেমন যেন জুবুথুবু। শ্লথ। ড্রিবলগুলোও কেমন নির্বিষ। আগের মতো ঝাঁঝ নেই। মনে হল, ইচ্ছে আছে ষোলো আনা, কিন্তু শরীর দিচ্ছে না। ওডাফার প্রথম গোলটার পিছনে দান ক্রিস্টোফারের। ক্রিস্টোর ব্যাক পাসে তিনি পা ঠেকিয়েছেন মাত্র। তাঁর দ্বিতীয় গোলটা সব অর্থেই ‘ওডাফা ব্র্যান্ড’। হাফ টার্নে বিপক্ষের তিন জনকে ছিটকে দিয়ে। তবে তিনি যে গোলগুলো মিস করেছেন, তা ক্ষমাহীন! দু’বছর আগের ওডাফা হলে হ্যাটট্রিক-সহ গোটা চারেক গোল আসতই তাঁর পা থেকে! “হ্যাটট্রিকটা করতে পারলে ভাল হত। ঠিক আছে দু’গোল তো করেছি।” দম নিতে নিতে বলছিলেন বাগান অধিনায়ক। মনে হল আপাতত ঝড় থেমে যাওয়ায় স্বস্তি পেয়েছেন।
পুণে জয়ে স্থগিত হয়ে গেল ক্লাবের কর্মসমিতির করিম-ওডাফা তাড়ানোর বৈঠক। দু’জনের কাছেই এ দিন সকাল থেকে অবশ্য এসেছে শীর্ষ কর্তাদের ফোন বা এসএমএস। উদ্বুদ্ধ করতে চেয়ে।
এই ম্যাচটা না জিততে পারলে কি ইস্তফা দিয়ে চলে যেতেন? নিজেকে ভাঙেননি মোহন-কোচ। “কী হত, তা নিয়ে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেব না। তবে বলব আমাকে নিয়ে যা চলছিল সেটা দুঃখ দিয়েছে।” সঙ্গে যোগ করলেন, “আজ যে ভাবে কর্তাদের কাছ থেকে ফোন বা এসএমএস এসেছে, এ রকম মরসুমের শেষ দিন পর্যন্ত এলে ভাল লাগবে।” ঘুরিয়ে হলেও কর্তাদের কটাক্ষ করে ফেলেন মোহন-কোচ।
কটাক্ষ তো করিম করবেনই, এখন যে তাঁর পৌষমাস!
মোহনবাগান: শিল্টন, সৌভিক, ইচে, রো উইলসন, প্রীতম, ডেনসন, কাতসুমি, রাম (রাজীব), সাবিথ (সাইজু) (পঙ্কজ), ক্রিস্টোফার, ওডাফা। |