টালির বাড়ি, নিজে লটারির টিকিট বিক্রি করেন। সামান্য আয় থেকেই ছেলেকে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। ছেলে বড় হয়ে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে, এমনটাই আশা ছিল। কিন্তু বুধবার রাতের ঘটনায় সব আশা ভেঙে গিয়েছে জগদ্দলের ৩ নম্বর স্কিমের গড়শ্যামনগরের বাসিন্দা চৈতন্য ঘোষের। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া ছেলে বেঁচে ফিরলেও খুনের দায়ে জেলে যেতে হবে, যেন ধরেই নিয়েছেন তাঁরা।
বুধবার রাতে শ্যামনগরের অঞ্জনগড় গলিতে চৈতন্যবাবুর বড় ছেলে শিশির খুর দিয়ে এক কিশোরীর গলা কেটে দেয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় শাঁওলি বিশ্বাসের (১৭)। এরপর শিশিরকে ধরে ফেলেন এলাকার বাসিন্দারা। শুরু হয় গণপিটুনি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। রাতেই পাঠানো হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। পুলিশ জানিয়েছে, হাসপাতাল থেকে ছাড়লেই গ্রেফতার করা হবে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শিশিরকে।
কেন শাঁওলিকে খুন করল মেধাবী, এলাকায় ভাল ছেলে বলে পরিচিত শিশির?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশিরদের বাড়ির কাছেই দোতলা বাড়ি ওই কিশোরীর। স্বচ্ছ্বল পরিবার। শাঁওলিকে শিশির পছন্দ করত অনেক দিন ধরেই। কিন্তু বছর দেড়েক আগে শাঁওলির বাবা সঞ্জয়বাবু জানিয়ে দেন, দু’জনের মেলামেশা পছন্দ করছেন তা তিনি। দূরত্ব বাড়তে থাকে শাঁওলি-শিশিরের। কিন্তু শিশির তা মানতে নারাজ ছিল। শেষ পর্যন্ত ওই যুবকের বাবা-মায়ের সঙ্গেও বাড়ি গিয়ে কথা বলে আসেন রেল-রক্ষী বাহিনীর জওয়ান সঞ্জয়বাবু। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে আসেন তাঁর আপত্তির কথা।
শাঁওলির পরিবারের কেউ অবশ্য বিষয়টি নিয়ে এ দিন মুখ খুলতে চাননি। চৈতন্যবাবু বলেন, ‘‘আমরা গরিব। ছেলেকে বুঝিয়েছিলাম। কষ্ট করে পড়াচ্ছি, একটা কিছু করতে হবে আগে। তারপর তো প্রেম-বিয়ে। ছেলে কথা শুনেছিল। এত দিন সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ কী যে হল!’’
তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের অনুমান, শিশিরের পরে অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল শাঁওলির। সেটা মানতে না পেরেই প্রতিহিংসায় খুন করে সে। অঞ্জনগড় গলির বাসিন্দারা জানান, যেখানে শাঁওলিকে খুন করেছে শিশির সেই গলিতেই এক সময়ে নিয়মিত দেখা যেত দু’জনকে। দীর্ঘ সময় ধরে গল্প করত তারা। ফলে মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল এলাকার অনেকেরই। স্থানীয় বাসিন্দা খোকন দত্ত বলেন, ‘‘ছেলেটা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছিল। ওকে ধরতেই মুখটা চেনা লাগল। আগে যেতে আসতে দেখতাম দু’জনকে এক সঙ্গে। আমাদেরও মেয়ে আছে। এতদিন একা পড়তে গেলে শুধু দুর্ঘটনার ভয় হত। এই ঘটনার পরে অন্য আতঙ্ক বেড়ে গেল।’’
এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন মনোবিদেরাও। কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কৌস্তভ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আতঙ্কটা স্বাভাবিক। কিন্তু বাবা-মায়েদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। বয়ঃসন্ধির সময়ে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই সব কিছু পেয়ে যায়। তাতে জেদ যত বাড়ে, ধৈর্য্যের মাত্রা কমতে থাকে। কাঙ্খিত কিছু না পেলেই ভীষণ হিংস্র হয়ে ওঠে।’’ কৌস্তভবাবুর মতে, ‘‘স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যেই এখন সবথেকে বেশি জেদ, হতাশা ও নেশার প্রবণতা। শ্যামনগরের ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সচেতন হতে হবে সকলকেই।”
|