|
|
|
|
বড়দিন রংহীন পাকুড়ের নিহত এসপি-র বাড়িতে
প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় • রাঁচি
১৯ ডিসেম্বর |
মাঝরাতে দূরপাল্লার চলন্ত ট্রেনে শিশুদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে খাকি পোশাক পরা এক দল দুষ্কৃতী। অবাধেই চলছে লুঠপাট এবং যাত্রীদের মারধর। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পাঁচটি কামরায় তাণ্ডব চালানোর পরে চেন টেনে মাঝপথে নেমে গেল দুষ্কৃতীরা।
বুধবার রাতে এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরে হাওড়ামুখী ভোপাল এক্সপ্রেসের যাত্রীরা ভেবেছিলেন, রেল পুলিশের কাছে গেলে সুরাহা মিলবে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো অভিজ্ঞতা হল তাঁদের। ডাকাতদের মারের পরে জুটল রক্ষক রেল পুলিশের পিটুনিও। ওই ট্রেনের যাত্রীরা জানান, গঢ়বা রোড স্টেশনে অভিযোগ নেওয়ার বদলে ঝাড়খণ্ডের রেল পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করতে শুরু করে। তাতে যোগ দেয় স্থানীয় গ্রামবাসীদের একাংশও। লাঠি ও ইটের আঘাতে কয়েক জন যাত্রী জখম হন। পরে অবশ্য রেলের অফিসারদের হস্তক্ষেপে অভিযোগ নেয় পুলিশ।
ঠিক কী ঘটেছিল? |
|
অমরজিতের ছবির পাশে স্ত্রী সুমনলতা। —নিজস্ব চিত্র। |
ঘরে থাকলে এতদিনে বড়দিনের পার্টির প্রস্তুতিতে মেতে উঠতেন তিনি। কেক তৈরি, ক্যাম্প-ফায়ার, একরত্তি মেয়ের সঙ্গে বল-ডান্স--- সবকিছুতেই তুখোর ছিলেন ওই আইএএস অফিসার।
এ বারও হয়তো তা-ই হতো। বাড়ির ছেলে ফিরলে নতুন বছরের অনুষ্ঠানে মেতে উঠতেন রাঁচির পাথলকুডুয়া এলাকায় একতলা বাড়ির বাসিন্দারা।
কিন্তু, মাস ছ’য়েক আগে আচমকা বদলে যায় সব পরিকল্পনা। জুলাই মাসে দুমকা থেকে পাকুড় ফেরার রাস্তায় মাওবাদী ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ, স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের বুলেটে নিহত হন পাকুড়ের এসপি অমরজিৎ বলিহার।
ক্রিসমাসের ‘রং’ তখনই ফিকে হয়েছিল বলিহার পরিবারে।
“বাবার সঙ্গে বল-ডান্স করতে খুব ভাল লাগত”---কথাটা বলতে বলতেই অমরজিতের ছোট্ট মেয়ের ঠোঁট থেকে পলকে উধাও হল হাসির রেখা। বলিহার পরিবারের বাড়ির দশ-বাই-দশ ফুটের ওই ঘরে হাজির আরও তিন জোড়া চোখ ততক্ষণে ঝাপসা। গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা--- বৃদ্ধ বাবা, বছর চল্লিশের ভাই, সদ্য-বিধবা স্ত্রী’র।
যিশু দিবসের জন্য সাজছে রাঁচি। শহরের অলিগলিতে হাজির সান্টাক্লজ। উৎসবের আমেজ ছুঁতে পারেনি অসহায় ওই মানুষগুলিকে।
নিহত পুলিশকর্তার মেজ ভাই সত্যজিতের কথায়, “এ সবে দাদার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। ঝাড়খণ্ড সশস্ত্র পুলিশের দায়িত্বে থাকাকালীন রাঁচির সদর দফতরের মাঠে ক্রিসমাস পার্টির আয়োজন করেছিল। উৎসবের সময় খুব মজায় কাটত। পাকুড়ে বদলির পর জানিয়েছিল, ছুটি না-পেলে এ বছর পাকুড়েই পার্টি হবে।”
ছুটির মানে বদলেছে ওই পরিবারের সবার কাছে।
এ বছর তা-ই উৎসব থেকে দূরেই থাকতে চান তাঁরা। ঘটনার পর মাত্র ছ’মাস কেটেছে। তার মধ্যেই ‘হিতাকাঙ্ক্ষী’র সংখ্যা কমেছে অনেক। তাঁরা জানান, পুলিশ বিভাগ থেকেও নিয়মিত যোগাযোগ করা হয় না। গত বছর ক্রিসমাস পার্টিতে যাঁরা ছিলেন, যোগাযোগ কমিয়েছেন তাঁরাও। সরকারি আর্থিক ক্ষতিপূরণ অবশ্য পাওয়া গিয়েছে। প্রশাসনিক আশ্বাস ছিল, রাঁচির ডাংরাটোলি চকের নামকরণ করা হবে অমরজিতের স্মৃতিতেই, তা এখনও হয়নি। শহিদের ‘প্রকৃত সম্মান’ অমরজিৎ পাননি বলেই অভিযোগ করছে তাঁর পরিবার।
যিশু দিবসের আগে, শোক আর অভিমানে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন নিজেদের।
কী হয়েছিল গত ক্রিসমাসে?
এক পলকে স্মৃতিতে ডুবল অমরজিতের ছোট মেয়ে শালিনী। মা সুমনলতার পাশে বসে গড়গড়িয়ে বলে চলল, “ক্যাম্প-ফায়ার হয়েছিল। বাবার সঙ্গে বল-ডান্স করেছিলাম। খুব মজা হয়েছিল।”
মায়ের চোখ তখন চিক্চিক্।
ঘরের দেওয়ালে ‘প্রভুর প্রার্থনা’। সেগুন কাঠের সোফার পাশে সাদা টেবিল-ক্লথ ঢাকা ছোট টেবিল। তার উপর রাখা ফটো-ফ্রেমে পুলিশের পোশাকে অমরজিৎ।
কথা বলতে বলতে বারবার সে দিকেই তাকাচ্ছিলেন চন্দ্রমোহন। বয়সের ভার, ছেলের মৃত্যুতে যেন জীবনীশক্তির অনেকটাই হারিয়েছে তাঁর। চশমা খুলে চোখ মুছলেন। বললেন, “গত বছর একা দায়িত্ব নিয়ে ক্রিসমাসের অনুষ্ঠান করল। সবার সঙ্গে হইচই হল। বাস্তব অনেক কঠিন তা শুনেছিলাম। আজ নিজেকে দেখে বুঝতে পারলাম।”
ক্রিসমাসের ‘স্বপ্নে’ ফের তা-ই মাততে চায় না অমরজিতের পরিবার।
|
পুরনো খবর: মাওবাদী হানা এ বার রাজ্যের দোরে, এসপি-সহ হত ৭ পুলিশ |
|
|
|
|
|