|
|
|
|
মাওবাদী হানা এ বার রাজ্যের দোরে,
এসপি-সহ হত ৭ পুলিশ
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় • দুমকা
প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় • রাঁচি |
প্রথমে ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস নেতাদের গাড়ির কনভয়, তার পরে বিহারে ট্রেনে হামলা। এ বার পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দোরগোড়ায় ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় পুলিশের গাড়িতে হানা দিয়ে পাকুড়ের পুলিশ সুপার-সহ সাত জন পুলিশকে হত্যা করল মাওবাদীরা।
মঙ্গলবার বিকেলে দুমকার কাঠিকুণ্ড এলাকার পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা যে-জায়গায় এই ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নলহাটি বড়জোর ৩০-৩৫ কিলোমিটার। মাওবাদীরা প্রথমে জঙ্গলের আড়াল থেকে এসপি-র গাড়ির সামনের চাকায় গুলি করে সে’টি থামায়। তার পর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে নির্বিচারে গুলি। ঘটনাস্থলেই মারা যান পাকুড়ের পুলিশ সুপার অমরজিৎ বলিহার, তাঁর গাড়ির চালক ও তিন দেহরক্ষী। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আরও এক জন পুলিশের মৃত্যু হয়। জখম হয়েছেন আরও তিন পুলিশকর্মী, তাঁদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যে-ভাবে এ দিন মাওবাদীরা হামলা চালিয়েছে, তাতে পাল্টা গুলি চালানো তো দূরের কথা, গাড়ি থেকে বেরোনোর সময়টুকুও পাননি এসপি ও তাঁর বাহিনী। বছর পঁয়তাল্লিশের অমরজিৎ ছিলেন একটি সাদা এসইউভি-তে। পিছনে অন্য একটি এসইউভি-তে ছিলেন তাঁর দেহরক্ষীরা। দুমকা-পাকুড় সড়কের ওই জায়গার রাস্তা কাঁচা। এসপি-র গাড়ির চাকা গুলিতে ফেঁসে যাওয়ার পর জঙ্গলের ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে যায় পুলিশের ওই দু’টি গাড়ির উদ্দেশে। পুলিশের বক্তব্য, মাওবাদীরা অন্তত দেড়শো রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে। চালকের ঠিক পিছনের আসনে বসেছিলেন পুলিশ সুপার। তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় মাওবাদীদের বুলেটে। মাওবাদীরা পুলিশদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলি লুঠ করে। ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার বলেন, “নিহত ও আহত পুলিশদের দু’টি একে-৪৭, চারটি ইনসাস রাইফেল, দু’টি নাইন এমএম পিস্তল ও ৬৭০ রাউন্ড গুলি লুঠ করেছে মাওবাদীরা।” |
মঙ্গলবার মাওবাদী হামলায় নিহত পুলিশকর্মীরা। ছবি: এএফপি। |
গুলিবর্ষণ বন্ধ হওয়ার বেশ কিছু ক্ষণ পর আহত এক পুলিশ গাড়ি থেকে কোনও রকমে বেরিয়ে মোবাইল থেকে কাঠিকুণ্ড থানায় ফোন করেন। ঘটনাস্থল থেকে কাঠিকুণ্ড থানা ৪ কিলোমিটার দূরে। প্রায় খানেক পর ওই জায়গায় পৌঁছয় ২০০ জন সিআরপি-সহ বিশাল পুলিশবাহিনী।
রাতে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থলে পড়ে রয়েছে পুলিশের গাড়ির কাচের ভাঙা টুকরো। কাঠিকুণ্ড থানায় রাখা পুলিশের দু’টি গাড়ির গায়ে বুলেটের অসংখ্য ছেঁদা। দু’টি গাড়ির ভিতরই রক্তে লাল। গাড়ির কাচ ভেঙে এসপি এবং পুলিশদের দেহ বার করা হয়।
দুমকা ও পাকুড় জেলায় এর আগে মাওবাদীরা বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপ ঘটালেও এত দিন ওই জেলা দু’টিকে সরকারি ভাবে মাওবাদী-প্রভাবিত জেলা বলে ঘোষণা করা হয়নি। ঝাড়খণ্ড পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল বি বি প্রধান বলেন, “এ দিনের ঘটনার পর পাকুড় ও দুমকাকেও মাওবাদী প্রভাবিত জেলা বলে ঘোষণা করা হল।”
পুলিশ সূত্রের খবর, দুমকায় ডিআইজি প্রিয়া দুবের সঙ্গে জরুরি বৈঠক সেরে পাকুড়ে ফিরছিলেন বলিহার। বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ জামনা জঙ্গল লাগোয়া গুমরা সেতুর উপরে ওই ঘটনা ঘটে। কাঠিকুণ্ড ও গোপীকন্দরের মাঝখানে ওই পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এলাকা বহু কাল ধরেই মাওবাদী প্রভাবিত। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় অমরজিৎ তাঁদের নিশানা হয়ে পড়েছিলেন। |
পাকুড়ের এসপি অমরজিৎ বলিহার। ছবি: এএফপি। |
কিন্তু মাওবাদীরা যে-কোনও সময়ে বদলা নিতে পারে, এমন গোয়েন্দা-তথ্য থাকার পরেও দু’টি গাড়িতে মাত্র আট জন পুলিশ নিয়ে এসপি কেন ওই জায়গা পার হচ্ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা জেনেছেন, নিজের নিরাপত্তায় অমরজিতের ঢিলেঢালা মনোভাব নজরে ছিল মাওবাদীরা। অথচ এই অমরজিৎই এক সময়ে বালুলাল মারাণ্ডি, শিবু সোরেন ও অর্জুন মুণ্ডা তিন জন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য নিরাপত্তা অফিসার ছিলেন। তবে ডিজি রাতে দুমকায় এক সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেন, “এসপি-র উপর মাওবাদীরা হামলা চালাতে পারে এমন কোনও আগাম তথ্য আমাদের হাতে ছিল না।” খবর পেয়েই ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার ও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব এনএন পাণ্ডে হেলিকপ্টারে কাঠিকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা হন।
রাতে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থলে পড়ে রয়েছে পুলিশের গাড়ির কাচের ভাঙা টুকরো। কাঠিকুণ্ড থানায় রাখা পুলিশের দু’টি গাড়ির গায়ে বুলেটের অসংখ্য ছেঁদা। দু’টি গাড়ির ভিতরই রক্তে লাল। গাড়ির কাচ ভেঙে এসপি এবং পুলিশদের দেহ বার করা হয়।
দুমকা ও পাকুড় জেলায় এর আগে মাওবাদীরা বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপ ঘটালেও এত দিন ওই জেলা দু’টিকে সরকারি ভাবে মাওবাদী-প্রভাবিত জেলা বলে ঘোষণা করা হয়নি। ঝাড়খণ্ড পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল বি বি প্রধান বলেন, “এ দিনের ঘটনার পর পাকুড় ও দুমকাকেও মাওবাদী প্রভাবিত জেলা বলে ঘোষণা করা হল।”
পুলিশ সূত্রের খবর, দুমকায় ডিআইজি প্রিয়া দুবের সঙ্গে জরুরি বৈঠক সেরে পাকুড়ে ফিরছিলেন বলিহার। বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ জামনা জঙ্গল লাগোয়া গুমরা সেতুর উপরে ওই ঘটনা ঘটে। কাঠিকুণ্ড ও গোপীকন্দরের মাঝখানে ওই পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এলাকা বহু কাল ধরেই মাওবাদী প্রভাবিত। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় অমরজিৎ তাঁদের নিশানা হয়ে পড়েছিলেন। |
মাওবাদী হানার পরে। দুমকার কাঠিকুণ্ড এলাকায়। সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি। |
কিন্তু মাওবাদীরা যে-কোনও সময়ে বদলা নিতে পারে, এমন গোয়েন্দা-তথ্য থাকার পরেও দু’টি গাড়িতে মাত্র আট জন পুলিশ নিয়ে এসপি কেন ওই জায়গা পার হচ্ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা জেনেছেন, নিজের নিরাপত্তায় অমরজিতের ঢিলেঢালা মনোভাব নজরে ছিল মাওবাদীরা। অথচ এই অমরজিৎই এক সময়ে বালুলাল মারাণ্ডি, শিবু সোরেন ও অর্জুন মুণ্ডা তিন জন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য নিরাপত্তা অফিসার ছিলেন। তবে ডিজি রাতে দুমকায় এক সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেন, “এসপি-র উপর মাওবাদীরা হামলা চালাতে পারে এমন কোনও আগাম তথ্য আমাদের হাতে ছিল না।” খবর পেয়েই ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার ও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব এনএন পাণ্ডে হেলিকপ্টারে কাঠিকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা হন।
এ বছরের ১৭ মে পাকুড়ের পুলিশ সুপার পদে যোগ দেন অমরজিৎ। তাঁর বাড়ি রাঁচি বরিয়াতু এলাকার জওহরনগরে। ২০০৩-এ তিনি আইপিএস হন। মাস কয়েক আগে মাওবাদীদের কাঠিকুণ্ডের এরিয়া কমান্ডার রামলাল রায় গ্রেফতার হওয়ার পর মাওবাদীরা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর বড়সড় আঘাত হানার ছক কষছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের সন্দেহ, রামলালের গ্রেফতারির বদলা নিতেই এ দিনের হামলা।
মাওবাদীদের কোন দল ওই হামলা চালিয়েছে?
প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা জেনেছেন, কাঠিকুণ্ড লাগোয়া ওই পাহাড়-জঙ্গলে আশুতোষ যাদব ওরফে আশুতোষজি নামে বিহারের এক মাওবাদী নেতার নেতৃত্বে প্রায় ২০ জন স্কোয়াড-সদস্য জড়ো হয়েছিল। আশুতোষজি বিহারের জামুইয়ের মাওবাদী কমান্ডার। ঘটনাস্থল থেকে জঙ্গলপথে জামুইয়ের দূরত্ব ৫৫-৬০ কিলোমিটারের বেশি নয়। গোয়েন্দারা আরও জেনেছেন, গিরিডি বা তার কাছাকাছি এলাকায় কিছু দিন আগে মাওবাদীদের এক বৈঠকে এই হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ঝাড়খণ্ড পুলিশের এক কর্তার কথায়, “যে-ভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে জামুইয়ের অন্যান্য এলাকা থেকেও মাওবাদী অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্যদের জড়ো করা হয়েছিল। সাধারণত প্রতিবেশী রাজ্য থেকেই অতিরিক্ত শক্তি জোগাড় করে থাকে মাওবাদীরা।” পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা থেকে আসা কয়েক জন মাওবাদী ওই হামলায় ছিলেন, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। |
নিহত অমরজিতের বাড়িতে ছেলের ছবির সামনে বৃদ্ধ বাবা।
পাশে স্ত্রী সুমনলতা। মঙ্গলবার রাঁচির বাড়িতে প্রশান্ত মিত্রের তোলা ছবি। |
২০১১-র নভেম্বরে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, বীরভূমে মাওবাদীদের একটি অ্যাকশন স্কোয়াড তৈরি হয়েছে এবং তাদের হাতে শিলদার ইএফআর শিবির থেকে ২০১০-র ১৫ ফেব্রুয়ারি লুঠ করা একটি ইনসাস রাইফেল এসেছে। কিন্তু তিন জন বাদে বীরভূমে ওই স্কোয়াডের আর কাউকে পুলিশ ধরতে পারেনি, উদ্ধার হয়নি আগ্নেয়াস্ত্রটিও। হামলার পর পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহ ও বীরভূম ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া চারটি জেলাতে পাহারা বাড়ানো হয়। |
|
যার গ্রেফতার হওয়ার বদলা হিসেবে পাকুড়ের এসপি-র উপর এ দিন হামলা চালানো হল বলে সন্দেহ, সেই রামলালের বাবা বদ্রীনাথও এক সময়ে মাওবাদীদের এরিয়া কমান্ডার ছিলেন। আট বছর জেলে থাকার পর সম্প্রতি বদ্রীনাথ জেল থেকে বেরিয়েছেন। রামলালকে যখন গ্রেফতার করা হয়, প্রায় সেই সময়েই সোনেলাল কিস্কু নামে রামগড়ের অন্য এক মাওবাদী এরিয়া কমান্ডারকে ধরে পুলিশ। জঙ্গলপথে কাঠিকুণ্ড ও রামগড়ের মধ্যে দূরত্ব বেশি নয়। স্থানীয় সূত্রে খবর, রামলাল-সোনেলালদের করিডর কাঠিকুণ্ডের জঙ্গল এলাকা। ওই দুই মাওবাদীকে গ্রেফতার করার পরে সাঁওতাল পরগনার পুলিশ খানিকটা আত্মতুষ্টিতে ছিল এই ভেবে, যে মাওবাদীরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তা যে সত্যি নয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল মাওবাদীরা। |
|
|
|
|
|