|
|
|
|
 |
জিরোনোর ঠাঁই নেই, ভ্রমণ কমছে কাঁকড়াঝোরে
কিংশুক গুপ্ত • কাঁকড়াঝোর |
|
শালবনের মাঝে গোলবারান্দা-সহ ছিমছাম এক বনবাংলো। তারই একটি ঘরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেছেন টেনিদা। ক্যাবলা, হাবুল, পটলরা তাতে মগ্ন। চিন্ময় রায় অভিনীত ‘চার মূর্তি’ ছবিতে মান্না দের সেই গান ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো...’ চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু যে বনবাংলোয় দৃশ্যটির শ্যুটিং হয়েছিল, সেই ‘বনানী’ আজ কেবল ধ্বংসের স্মৃতি। সেই সঙ্গে অতীত হয়ে গিয়েছে পর্যটনকেন্দ্র কাঁকড়াঝোর। একদা ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণ বেলপাহাড়ির এই এলাকায় পরিকাঠামোর অভাবে আজ আর কেউ আসতেই চান না। |
 |
জিরো গ্রাউন্ড। এখানেই এক সময়ে ছিল বনবাংলো ‘বনানী’। ২০০৪ সালে
মাইন বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যায় তা। এখন শুধুই শূন্যতা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
পর্যটনে ভাটার শুরুটা হয়েছিল কিন্তু মাওবাদী ভীতির কারণে। ২০০৪ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ‘বনানী’ উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। পাশে প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রে ক্ষতি হয়েছিল তুলনায় কম। পরে ভ্রমণ কেন্দ্রের ভবন সংস্কার করে সিআরপি ক্যাম্প তৈরি হয়। এখনও সেখানে ক্যাম্প রয়েছে। কিষেনজির মৃত্যুর পরে জঙ্গলমহলে মাওবাদী সক্রিয়তা থিতিয়েছে। পর্যটকরাও ফের জঙ্গলমহলমুখী হতে শুরু করেছেন। কিন্তু সেই তালিকায় পরিকাঠামোর অভাবে জায়গা করে নিতে পারছে না কাঁকড়াঝোর।
এই মুহূর্তে কাঁকড়াঝোরে পর্যটকদের থাকার কোনও জায়গা নেই। নেই ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নেওয়ার মতো জায়গা। নিদেনপক্ষে সাধারণের ব্যবহার্য একটি শৌচাগারও নেই গোটা চত্বরে। এক সময় স্থানীয় বাসিন্দা গোপীনাথ মাহাতোর মাটির বাড়িতে বেসরকারি ভাবে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। গোপীনাথবাবুর মৃত্যুর পরে সেটিও বেহাল। প্রাক্তন বনকর্মী অনিমেষ দাশগুপ্ত কর্মসূত্রে ষাট, সত্তর ও আশির দশকে একাধিকবার কাঁকড়াঝোর বনবাংলোয় রাত্রিযাপন করেছেন। বছর পঁচাত্তরের অনিমেষবাবু বলেন, “সম্প্রতি কাঁকড়াঝোরে গিয়ে ভীষণ হতাশ হয়েছি। ওখানে নতুন করে পর্যটন পরিকাঠামো গড়ে তোলা হলে গরিব বাসিন্দারা উপকৃত হবেন।” দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের সঞ্চয়িতা প্রামাণিকের আক্ষেপ, “আশির দশকে ছোট বেলায় কাঁকড়াঝোর বন বাংলোয় থেকেছিলাম। আড়াই দশক পরে কাঁকড়াঝোর বেড়াতে এসে থাকার জায়গা না পেয়ে ফিরে আসতে হল।”
অথচ পাহাড়, জঙ্গলঘেরা অপরূপ নিসর্গের টানে এক সময় কাঁকড়াঝোরে উৎসাহীদের ঢল নামত। পর্যটকদের সুবিধার্থে ষাটের দশকে ‘বনানী’ তৈরি করে বন দফতর। তবে সেখানে ঘর ছিল মাত্র দু’টি। তাই ২০০১ সালে রাজ্য বন উন্নয়ন নিগম পাশেই দোতলা ‘প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র’ তৈরি করা হয়। সেখানে থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছিল। পর্যটকরা আসায় বছরে ছ-সাত মাস স্থানীয় আদিবাসীরাও বিকল্প রোজগারের সুযোগ পেতেন। কেউ গাইডের কাজ করতেন, কেউ পর্যটকদের জন্য রান্না করে দিতেন। স্থানীয় মঙ্গল সিংহ, সুনীল সিংহরা বলেন, “যখন বনবাংলো ছিল, তখন নিয়মিত লোকজন আসতেন। অনেকে এসে রাত কাটাতেন। আমরা গাইডের কাজ করে দিনে ১০০ টাকা রোজগার করতাম।” কাঁকরাঝোরের দুর্গা সিংহ, মালতী সিংহরা বলছেন, “কলকাতার বাবুরা দিশি মুরগির খোঁজ করতেন। একটা গোটা মুরগির জন্য ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম পেতাম আমরা।”
বেলপাহাড়ি থেকে ওদলচুয়া হয়ে চড়াই-উতরাই পিচরাস্তা ধরে ২২ কিলোমিটার গেলে কাঁকড়াঝোর। ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা এই গ্রাম একেবারে ছবির মতো। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক জুড়ে পাহাড়ের সারি। দক্ষিণ-পুবে রয়েছে মারো পাহাড়, দক্ষিণ-পশ্চিমে খচলা পাহাড়। আর পশ্চিমে চোখজুড়োনো লাকাইসিনি পাহাড়। চারিদিকে ঘন শালজঙ্গল। পিয়াশাল, কেঁদ, নিম, হরিতকি, বহেড়ার মতো গাছগাছালিরও অভাব নেই। গ্রামবাসীরা জানালেন, জঙ্গলে মাঝেমধ্যে বুনো শুয়োর ও সজারু দেখা যায়। ময়ূরও রয়েছে বেশ কিছু। কাঁকড়াঝোরের প্রবীণ বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ সিংহ বলেন, “বছর দশেক আগেও পর্যটকদের ভিড় থাকত এখানে।”
ঝাড়গ্রাম হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন কর্মকার বলেন, “এ বছর মরসুমে এখনও পর্যন্ত প্রায় চারশো পর্যটক কাঁকড়াঝোর বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেখানে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদের একটি বড় অংশ কাঁকড়াঝোর যেতে চাইছেন না।” ঝাড়গ্রামের ভাড়ার গাড়ি চালক শেখ সাবের আলি বলেন, “কাঁকড়াঝোরে পর্যটকদের জন্য কোনও রকম ব্যবস্থা নেই। গাড়ি ভাড়া বাবদ দেড়-দু’হাজার টাকা খরচ করে পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে হতাশ হচ্ছেন। সরকারের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।” বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির কংগ্রেস সদস্য সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “কাঁকড়াঝোরের পরিকাঠামো উন্নয়নে অবিলম্বে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ করা উচিত।”
প্রশাসন আশার কথা শোনাচ্ছে না। রাজ্যের মুখ্য বনপাল (পশ্চিম চক্র) এন ভি রাজাশেখর বলেন, “কাকড়াঝোরে নতুন করে বন বাংলো তৈরির কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।” |
|
|
 |
|
|