রাহুল গাঁধীর কথা অমৃতসমান। বৎসরের গোড়ায় তিনি বলিয়াছিলেন, ক্ষমতা বিষ। দিল্লিতে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং আম আদমি পাটি মন্ত্রিসভা গড়িতে যে পরিমাণ অনীহা দেখাইতেছে, তাহাতে সংশয় হয়, কংগ্রেস সহসভাপতির কথাটি বুঝি অকাট্য। বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিতে পারে নাই বটে, কিন্তু একক বৃহত্তম দল হিসাবে নির্বাচিত হইয়াছে। তাহার পরেও সরকার না গড়িবার সিদ্ধান্তটিতে পলায়নী মনোবৃত্তি প্রকট। কংগ্রেস, আপন কর্মফলেই, আগামী পাঁচ বৎসর তাহাদের পথে বাধা হইবার ক্ষমতা অর্জন করিতে পারিবে না। আপ-ও এক প্রকার জানাইয়া দিয়াছিল, প্রশ্নভিত্তিক সমর্থনে তাহাদের অমত নাই। কাজেই, বিজেপি সরকার গড়িতেই পারিত। তাহাতে গণতন্ত্রের একটি বৃহৎ অনুশীলনেরও অবকাশ থাকিত, যেখানে যে কোনও প্রশ্নেই শাসক এবং বিরোধীর একমত হওয়া আবশ্যিক হইত। বিজেপি সেই পথে হাঁটিল না।
আম আদমি পার্টির নিকট যে এই বিপুল নির্বাচনী সাফল্য অপ্রত্যাশিত ছিল, তাহা দলের নেতারাই স্বীকার করিতেছেন। তাঁহারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নহেন, একক বৃহত্তম দলও নহেন— কিন্তু বিজেপি-র সিদ্ধান্তে আপ সরকার গঠনের সুযোগ পাইয়াছে। কংগ্রেস নিঃশর্ত সমর্থনের কথা ঘোষণা করিয়া দিয়াছে। আপ-এর নেতারা সরকার গঠনের পূর্বশর্ত হিসাবে যে ১৮ দফা দাবি পেশ করিয়াছিলেন, কংগ্রেস তাহাতেও আপত্তি করে নাই। যেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আপ-এর ন্যায় একটি সদ্যোজাত দলকে ভোট দিয়াছে, এবং সরকার গঠনেরও সুযোগ আসিয়াছে, তখন সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করাই কর্তব্য। কিন্তু, সেই পথে না হাঁটিয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা ফের দিল্লিবাসীর নিকট চিঠি লিখিয়া, এসএমএস করিয়া, পথসভা করিয়া জানিতে চাহিতেছেন, সরকার গঠন করা কি উচিত হইবে? যেখানে মানুষ ভোটিং মেশিনেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়াছেন, সেখানে ফের প্রশ্নটি তুলিবার অর্থ কী? আপ নেতারা বলিতে পারেন, তাঁহারা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের একটি নূতন মডেল পরীক্ষা করিতে চাহিতেছেন, যেখানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের মত যাচাই করিয়া লওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাত্ত্বিক ভাবে এই অবস্থানটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। কিন্তু, প্রথমে সমর্থন গ্রহণের শর্তাবলি পেশ করা, তাহার পর মানুষের রায় লইতে চাওয়া— কেহ যদি বলেন, সব মিলাইয়া বোধ হইতেছে আম আদমি পার্টি ঘুরপথে সরকার গঠনের দায় এড়াইতে ব্যস্ত, কথাটি অস্বীকার করিবার উপায় থাকিবে কি?
‘অরাজনৈতিক’ মানুষদের সংগঠিত করিয়া নির্বাচনে আশাতীত ফল করিলেও আপ রাজনীতির পরিসরে হালে পানি পাইতেছে না, এই আশঙ্কাটি প্রকট হইয়া উঠিতেছে। তাহা কেবল এই দলটির পক্ষেই দুর্ভাগ্যজনক নহে, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষেও একটি বড় ক্ষতি। ‘রাজনৈতিক’ দলগুলির উপর যে বহু মানুষ আস্থা হারাইয়াছেন, তাহা দিল্লির নির্বাচনে স্পষ্ট। গোটা দুনিয়াতেই রাজনৈতিক পরিসরের প্রতিস্পর্ধী হিসাবে নাগরিক সমাজের উত্থান ঘটিতেছে। কিন্তু, সেই ‘অরাজনৈতিক’ শক্তিকে রাজনীতির পরিসরে আনিয়া গণতন্ত্রের পরীক্ষায় বসাইবার কাজটি অরবিন্দ কেজরিওয়ালরাই করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই ‘স্পর্ধা’ ফলপ্রসূ হইয়াছে। অনুমান করা চলে, দেশের অন্য প্রান্তেও এমন ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটিবে। কিন্তু, নির্বাচনে জয়লাভের পর কী— এই প্রশ্নটির একটি সন্তোষজনক উত্তর যদি কেজরিওয়ালরা না দিতে পারেন, যদি প্রতিভাত হয় যে নিজেদের সাফল্যকে গণতান্ত্রিক পরিসরে ব্যবহার করিবার ক্ষমতা তাঁহাদের নাই, তবে এই গোত্রের ‘অরাজনৈতিক’ রাজনৈতিক শক্তির উপর মানুষ বিশ্বাস হারাইতে পারেন। তাহাতে মস্ত ক্ষতি। সেই ক্ষতি এড়াইবার দায় একান্ত ভাবেই কেজরিওয়ালদের। দিল্লিতেই তাঁহাদের প্রমাণ করিতে হইবে, জনাদেশের সম্মান রক্ষার ক্ষমতা তাঁহাদের আছে। |