|
|
|
|
|
|
কুবের উবাচ |
অতনু ভক্ত (২৪) • স্ত্রী (১৯) • বাবা (৫৬) • মা (৫০) • ভাই (২০) • ঠাকুরমা (৭৫)
নিজের ছোট ব্যবসা • গ্রামের পুরনো বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন • পারিবারিক চাষের জমি আছে
• বাইক কিনতে চান • ইচ্ছে, আগামী দিনে নিজের বাড়ি তৈরির • স্বপ্ন, সচ্ছল ভবিষ্যতের |
 |
মাসে নিট আয় |
• ব্যবসা থেকে
১৬,০০০ |
• ফসল বিক্রি করে
১,৫০০ |
|
সম্পদ |
• সেভিংস অ্যাকাউন্ট
১৫,০০০ |
খরচ (মাসে) |
• সংসারে দেন
৬,০০০ |
• স্বর্ণঋণের কিস্তি
৯৬০
(মোট ঋণ ৪৮,০০০) |
• কৃষিঋণের কিস্তি
১,৫০০
(মোট ঋণ ৫০,০০০, ৫ বছর বাকি) |
• দুর্ঘটনা বিমা (গ্রুপ ইনশিওরেন্স)
৮.৩৩ (বিমা মূল্য ৪ লক্ষ)
|
• ল্যাপটপের দামের কিস্তি
২,৮৬৫ (৫ মাস বাকি) |
|
 |
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
শৈবাল বিশ্বাস |
|
অন্য প্রোফাইলগুলির থেকে অতনুরটি কিন্তু অনেকটাই আলাদা। অতনু নিজের পরিবারের সঙ্গে গ্রামে থাকেন। তাঁর পরিবার কৃষিকাজে যুক্ত। তিনি নিজের ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন। অল্প বয়সেই নিজের আর্থিক পরিকল্পনা নিয়ে তিনি আগ্রহী, যা দেখে ভাল লাগল। তাঁর প্রোফাইল নিয়ে আলোচনার আগে গ্রামের মানুষদের, বিশেষত কৃষিজীবী পরিবারের আর্থিক পরিকল্পনা এবং তার সমস্যা নিয়ে কিছু কথা বলে নিতে চাই।
১) অনেক সময়েই কৃষিজীবী মানুষরা উপার্জনের পুরোটা ফের চাষের কাজে লাগাতে বাধ্য হন। তাই আলাদা আর্থিক পরিকল্পনা করা সম্ভব হয় না।
২) আমাদের দেশে ফলন এখনও প্রকৃতির উপর (বিশেষত বর্ষা) নির্ভর করে। ফলন ভাল না-হলে, আয়ও সে রকম হবে না। আর এই অনিশ্চয়তাই নিয়মিত লগ্নি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় বাধা।
৩) চাষের জন্য ঋণ নেওয়া থাকলে, খারাপ ফলনের জেরে তা শোধ করতে অসুবিধার হয়। ফলে আর্থিক পরিকল্পনা করা সমস্যার।
৪) অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের অভাবে কৃষক পরিবারের সদস্যরা অন্য পেশা বেছে নিতে পারেন না। ফলে একই পরিমাণ জমির উপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ে। তাই বাড়ে অনটনও।
৫) সরকার চেষ্টা করলেও, গ্রামাঞ্চলে এখনও সব জায়গায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা মেলে না। ডাকঘর বা বিমা সংস্থার উপস্থিতি ও টিভি-ইন্টারনেটের ব্যবহার থাকলেও, তা লগ্নি সম্পর্কে মানুষকে সঠিক তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট নয়। ফলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে। এখন ব্যাঙ্কগুলি গ্রামে অনেক বেশি শাখা খুলতে আগ্রহী হয়েছে, তা ভাল খবর। এতে লগ্নির ক্ষেত্রে কিছুটা সুরক্ষা পাওয়া যাবে।
আসুন এ বার চোখ রাখি অতনুর প্রোফাইলে। তাঁর জীবনে অনেক ছোট ছোট স্বপ্ন রয়েছে। যা কিছুটা ছড়ানো-ছেটানো। কোন লক্ষ্যপূরণের প্রয়োজন আগে, সে সম্পর্কে তাঁর ধারণার অভাব রয়েছে। চেষ্টা করব, প্রয়োজন অনুসারে সেই লক্ষ্যগুলিকে সাজিয়ে দেওয়ার। কোনটা না-হলেই নয়, কীসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ও কেন— তা-ও বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব।
এখন তাঁর হাতে মাসে প্রায় ৬ হাজার টাকা থাকে। ল্যাপটপের কিস্তি শেষ হলে তাঁর হাতে মাসে থাকবে প্রায় ৯ হাজার। ফলে সেই হিসাবেই পুরো বিষয়টি সাজাব। তবে কিছু লগ্নি তিনি এখনই শুরু করতে পারেন। |
ঋণ শোধ |
• অতনুর ৪৮ হাজার টাকা স্বর্ণঋণ রয়েছে। চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, এ জন্য প্রতি মাসে ২% করে সুদ দিতে হয়। অর্থাৎ বছরে সুদ ২৪%, যা অত্যন্ত চড়া। আপাতত শুধু এ জন্য মাসে ৯৬০ টাকাই দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আসল শোধ করা বাকিই থাকছে। পাশাপাশি, তিনি স্পষ্ট জানাতে না -পারলেও, সাধারণত এই ধরনের ঋণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ সময়ে ঋণ শোধ না-হলে, আসলের সঙ্গে সুদ যুক্ত হয়ে তার উপর আবার সুদ ধরা হয়। সেই কারণে যত দ্রুত সম্ভব এই ঋণ শোধ করুন।
আমার পরামর্শ, আপাতত এই সুদ চলুক। কিন্তু এর সঙ্গে এক বছর মেয়াদের রেকারিং খুলুন। সেখানে প্রতি মাসে ৩,৫০০ টাকা রাখুন। মেয়াদ শেষে ওই টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করুন। তবে এই সময়ের মধ্যে যদি হাতে কোনও থোক টাকা আসে, সেখান থেকে আগে কিছুটা হলেও ঋণ শোধের ব্যবস্থা করুন। তার পর রেকারিং-এর টাকা পেলে পুরো ঋণ মিটিয়ে দিন।
• ল্যাপটপের দামের কিস্তি বাকি আর চার মাস। ফলে সেটি শেষ করুন।
• অতনুর কৃষিঋণ রয়েছে ৫০ হাজার টাকার। চাষের ফসল বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়েই সেই ঋণ শোধ করেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তা নিয়ম মতো শোধ করতে থাকুন। |
জীবনবিমা |
এখন এসবিআইয়ের যে-বিমাটি আছে, তাতে শুধু দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ মিলবে। অন্য কোনও কিছুর ক্ষেত্রে নয়। পাশাপাশি, অতনু বিবাহিত ও নিজে ব্যবসা চালান। ফলে অন্য লগ্নির আগে তাঁর একটি ভাল জীবন বিমা জরুরি।
৩০ বছর মেয়াদে ১৫ লক্ষ টাকার টার্ম পলিসি করুন। এতে তাঁর খরচ হবে বছরে প্রায় ৩,১০১ টাকা, মাসে ২৫৯ টাকা। টার্ম পলিসিতে মেয়াদ শেষে টাকা ফেরত মেলে না। শুধু জীবনের সুরক্ষা পাওয়া যায়। যে কারণে এর প্রিমিয়াম অন্য বিমার তুলনায় অনেকটা কম। ৩০ বছর পূর্ণ হলে এর মেয়াদ ও কভারেজ আরও বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। |
স্বাস্থ্যবিমা |
অতনু এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনের জন্য একটি ফ্যামিলি ফ্লোটার স্বাস্থ্যবিমা করা উচিত এখনই। সন্তান হলে, তাকেও এই বিমার আওতায় আনতে হবে। ৩ লক্ষ টাকার বিমার জন্য খরচ পড়বে বছরে ৪,৭১৯ টাকা। মাসে ৩৯৩ টাকা। |
সন্তানের জন্য সঞ্চয় |
অতনু ও তাঁর স্ত্রীর খুবই কম বয়স। তাঁদের সন্তানও নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে যখন নিজের পরিবার শুরু করবেন, তখন সন্তানের পড়াশোনা, বিয়ে ইত্যাদির জন্য টাকা জমাতেই হবে। তাই এখন থেকেই সে জন্য প্রস্তুত হোন।
এ জন্য ব্যাঙ্কে মাসে ১,০০০ টাকা করে রেকারিং শুরু করুন। যদি তিন বছর পরও তাঁদের সন্তান হয়, সে ক্ষেত্রে ২১ বছর পর সন্তানের বয়স দাঁড়াবে ১৮। তখন সেই টাকা তার উচ্চশিক্ষার কাজে লাগাতে পারবেন। সেই সময়ে রেকারিং থেকে তাঁর হাতে আসবে প্রায় ৬.৫ লক্ষ টাকা (৮% সুদ ধরে)। |
বাড়ি কিনতে লগ্নি |
১০-১৫ বছর পর নিজেদের জমিতেই একটি বাড়ি তৈরি করতে চান অতনু।
• স্বর্ণঋণ শোধ হয়ে গেলে এক বছরের মেয়াদে নতুন রেকারিং শুরু করুন। সেখানে মাসে ১,৫০০ টাকা করে রাখুন। মেয়াদ শেষে সেই টাকা স্থায়ী আমানতে রেখে দিন। যত দিন না বাড়ি তৈরিতে হাত দিচ্ছেন, তত দিন এই ভাবে লগ্নি চালিয়ে যান। দেখবেন, বাড়ি তৈরির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যেন সমস্ত টাকা হাতে আসে। এই ভাবে টাকা জমিয়ে কিছুটা হলেও বাড়ির খরচ মেটানো যাবে। |
সচ্ছল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে |
অতনুর সামনে এখনও অনেক সময় রয়েছে সচ্ছল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার। তাঁর অবসর নেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু তা-ও যদি ধরে নিই তিনি ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যবসা চালাবেন, তা হলে তাঁর হাতে ৩৬ বছর রয়েছে অবসর জীবনের টাকা জমানোর জন্য।
১) ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে ১,০০০ টাকা করে রেকারিং ডিপোজিট শুরু করুন।
২) বছরে ১২,০০০ টাকা করে এনএসসি করুন।
৩) স্বর্ণঋণ শোধ হলে নিজের ব্যাঙ্কে একটি পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলুন। এতে বছরে কমপক্ষে ২৪,০০০ টাকা (মাসে অন্তত ২,০০০ টাকা) করে রাখুন। মনে রাখবেন, পিপিএফে বছরে ন্যূনতম ৫০০ টাকা রাখতেই হয়। আর বছরে সবচেয়ে বেশি ১ লক্ষ টাকা রাখা যায়। প্রথম বার পিপিএফ করতে হয় ১৫ বছরের জন্য। তার পর পাঁচ বছর করে তা বাড়ানো যায়। পিপিএফের টাকা সম্পূর্ণ করমুক্ত।
• অতনুর বয়স কম হওয়ায় আমি তাঁকে লগ্নির ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার পরামর্শ দিতাম। সে জন্য কোনও ভাল মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্পে মাসে ১,০০০ টাকা করে রাখতে বলতাম। কিন্তু, গ্রামে থাকার কারণে বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। ফলে লগ্নিতে ভুল হতে পারে। হতে পারে বড় ক্ষতিও। তাঁর সঞ্চয়ের টাকা মার যাক, তা কখনওই চাইব না। সে জন্য আপাতত এই ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেব না।
তবে তাঁকে বলব, ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ বিষয়ে নিজে একটু পড়াশোনা করুন। আগামী দিনে কোনও বিশ্বস্ত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে প্রকল্প ঠিক করতে পারলে, তবেই মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করুন, না-হলে নয়। |
মোটরসাইকেল কেনা |
অতনু বাইক কিনতে চান। কিন্তু আমার মত, আপাতত এ জন্য কিছু দিন অপেক্ষা করুন। আগে ঋণ শোধ হোক, সংসারের জন্য সঞ্চয় শুরু করুন, জীবনবিমা ও স্বাস্থ্যবিমা করান। তার পর বাইক কেনার কাজে হাত দিন। চেষ্টা করবেন, এ জন্য যতটা সম্ভব কম ঋণ নিতে।
অতনু এবং স্ত্রীর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের আগাম শুভেচ্ছা রইল। |
|
|
 |
|
|